'এখন মেয়েটার শরীরে চামড়া নাই'

শেখ সামাওয়া জাহরি সরৌশী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
শেখ সামাওয়া জাহরি সরৌশী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

‘আমার তুলতুলে একটা মেয়ে ছিল। এখন মেয়েটার শরীরে চামড়া নাই। মেয়েকে দেখে আমরা আর সহ্য করতে পারছি না। এটা মানা যায় না। মানতে পারছি না। সবকিছু সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দিয়েছি’—এভাবেই কথাগুলো বললেন শেখ গোলামুন্নবী জায়েদ। তাঁর মেয়ে শেখ সামাওয়া জাহরি সরৌশী।মাত্র ২ বছর ৪ মাস বয়সী মেয়েটা এখন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি। গরম পানিতে ঝলসে গেছে ছোট শরীরের বেশির ভাগ অংশ। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, পোড়ার পরিমাণ ৩৩ শতাংশ।


শেখ গোলামুন্নবী জায়েদ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ ২৪-এর প্রতিবেদক এবং সংবাদ উপস্থাপক। সরৌশীর মা ওরিন নাশিদ ঋদি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক। ২৪ জানুয়ারি বিকেলে রান্নাঘরে গামলার মধ্যে রাখা গরম পানিতে ঝলসে গেছে সরৌশী। ঘটনার পর প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি ছিল। সেখান থেকে গতকাল রোববার রাতে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসক প্রদীপ চন্দ্র দাসের অধীনে ভর্তি আছে।

শেখ গোলামুন্নবী জায়েদ বললেন, ‘আমার মেয়েটা মাত্র কথা বলা শিখছে। ভাঙা ভাঙা শব্দে অনেক কথা বলে। এক, দুই, তিন বলে, তারপর আমাকে বলতে হয় “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” বাংলাদেশকে বলে বান্দাদেশ। ঘটনার পর থেকে শুধু আমাদের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কান্নাকাটি করে। ও তো কখনো রান্নাঘরে যেত না। চোখের পলকে সেদিন সেখানেই গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেছে ঘটনাটা। ওর মা শুধু ফোন রিসিভ করে, এই ফাঁকেই সে চলে যায় রান্নাঘরে। অথচ বাসায় সারাক্ষণই ওকে চোখে চোখে রাখে ওর মা, না হয় বাসার কাজের সাহায্যকারী মেয়েটা।’

মা-বাবার সঙ্গে সরৌশী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
মা-বাবার সঙ্গে সরৌশী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

শেখ গোলামুন্নবী জানান, মেয়ের মুখ, মাথা পুড়তে না পারলেও শরীরের ডান পাশের বেশির ভাগ অংশই পুড়ে গেছে। ঘটনার পর সরৌশীর মা মেয়ের শরীরে পানি ঢেলেছেন। তবে গায়ের জামা খুলতে গেলে জামার সঙ্গে শরীরের চামড়াও উঠে আসে।

চাকরিসূত্রে শেখ গোলামুন্নবী ঢাকায় থাকতেন। স্ত্রী ওরিন নাশিদ হৃদি আর মেয়ে চট্টগ্রামে থাকত। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ গোলামুন্নবীর চট্টগ্রাম অফিসে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেছে এই দুর্ঘটনা।

শেখ গোলামুন্নবী আরও বলেন, ‘মেয়েটাকে সেভাবে কাছে পেতাম না। মেয়েটার জন্যই চট্টগ্রাম চলে যেতে চেয়েছিলাম। আর এখন তো বলতেও পারছি না মেয়েটার ভাগ্যে কী আছে। সবাই আমার মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন।’ এই বাবা জানালেন, তাঁর মেয়ের নাম ‘সরৌশী’ একটি স্প্যানিশ শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে ‘ভাগ্যবতী’।

সরৌশীর বাবার ফেসবুক পোস্ট।
সরৌশীর বাবার ফেসবুক পোস্ট।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাস প্রথম আলোকে বললেন, শিশুদের বেলায় ১০ শতাংশের বেশি পুড়লেই তাকে গুরুতর পোড়া বলে। এই শিশুটির শরীরের প্রায় ৩৩ শতাংশই পুড়ে গেছে। তাই সেভাবে বলা কঠিন, তবে চিকিৎসকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন এবং ইনস্টিটিউটে গুরুতর পোড়া রোগীদের ভালো করে বাড়ি পাঠানোর ইতিহাসও আছে।

প্রদীপ চন্দ্র দাস আরও বলেন, বাড়িতে ঘটা দুর্ঘটনার মধ্যে গরম পানি, গরম দুধ বা গরম তরকারিতে পোড়া রোগী বেশি পাওয়া যায়। বাড়িতে শিশু থাকলে এসব ক্ষেত্রে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রান্নাঘর থেকে গরম পানি বাথরুমে নেওয়ার ক্ষেত্রে বালতিতে করে নিতে হবে। আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে পোড়া অংশ বা পুরো শরীরকেই টেপের নিচে রেখে পানি ছেড়ে দিতে হবে। পোড়া জায়গা গরম থাকে, পানি ঢাললে তা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে থাকে, তখন আর পোড়াটা গভীর হতে পারে না। পোড়া জায়গাটা দ্রুত শুকিয়ে যায়। জটিলতা কম হয়।