উচ্চ শব্দে অতিষ্ঠ মানুষ

নেত্রকোনায় রিকশা, অটোরিকশা ও ইজিবাইকে মাইক লাগিয়ে এলইডি বাল্ব, ডিটারজেন্ট পাউডার, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রাইভেট হাসপাতাল, প্যাথলজি, কিন্ডারগার্টেন, কোচিং সেন্টারে ভর্তিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচার চলছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই প্রচার আর গাড়ির হর্নে অতিষ্ঠ শহরবাসী।

এ ছাড়া প্রায় দেড় মাস ধরে শহর ও আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে উচ্চ শব্দে মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ও অসহনীয় শব্দদূষণে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। বিশেষ করে শিশু, অসুস্থ রোগী ও পরীক্ষার্থীদের বেশি সমস্যা পোহাতে হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাস দেড়েক ধরে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও জেলা শহরের সাতপাই পালপাড়া, রেলক্রসিং, গাড়া রোড, সাকুয়া, খতিবনগুয়া, জয়নগর, মোক্তারপাড়া, মইনপুর, নাগড়া, রাজুরবাজার, মালনি, ইসলামপুর, পারলা, বনুয়াপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে উচ্চ শব্দে মাইক–সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। দিনের বেলা ছাড়াও সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া রিকশা, ইজিবাইক ও অটোরিকশায় মাইক ব্যবহার করে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চিকিৎসক, কিন্ডারগার্টেন, কোচিং সেন্টারগুলোতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচার চলছে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ফলে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়গুলোতে দৈনন্দিন কাজ সারতে সমস্যায় পড়ছেন সংশ্লিষ্ট লোকজন।

গত সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত শহরের মোক্তারপাড়া এলাকায় অবস্থান করে দেড় ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সদর উপজেলার অন্তত তিনটি এনার্জি-এলইডি বাল্ব, একটি স্থানের ধর্মীয় প্রচার, একটি দোকানের প্রচার, একটি কিন্ডারগার্ডেন, দুটি ডায়াগনস্টিক, একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রচার শোনা যায়। এ সময় উচ্চ শব্দে মাইক বাজিয়ে এনার্জি সেভার বৈদ্যুতিক বাল্ব বিক্রি করছিলেন আরিফ মিয়া (৩০)। তিনি বলেন, ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে মাইক বাজাতেই হয়।

শহরের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, এভাবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিদিন উচ্চ শব্দে মাইক বাজিয়ে বাল্ব বিক্রি, সভা-সমিতি, রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের কর্মসূচি, ভোগ্যপণ্য, চিকিৎসকের সেবা, মলম-মাজন-ইঁদুরের ওষুধ বিক্রি, গরু-ছাগল জবাইসহ নানা প্রচারণা চালানো হয়। ফলে রাস্তার পাশে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাসপাতাল, অফিস, ব্যাংক-বিমার দাপ্তরিক কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে।

মোক্তারপাড়া এলাকার এসএসসি পরীক্ষার্থী শারমিন বলেছে, সোমবার থেকে তার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। রাতের বেলা মাইকের কর্কশ আওয়াজে পড়ার মনোযোগ নষ্ট করে দেয়, মাথা ধরে যায়।

ছোটবাজারের ব্যবসায়ী খায়রুল হক বলেন, ‘শহরে উচ্চ শব্দে রাত-দিন মাইকিং চলছে। মাইকিংয়ের আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। এতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি।’

সাতপাই নদীর পাড় এলাকার বাসিন্দা কবি শিমুল মিলকী বলেন, শহরে উচ্চ শব্দে রাত-দিন মাইকিং চলছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে উচ্চ শব্দে মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘুমানো যায় না। মাথাব্যথা করে। এসব বন্ধে প্রশাসনের পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টসহ কঠোর নজরদারি না হলে এই উপদ্রব থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহনীয় মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত শব্দ মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ। মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণে শ্রবণশক্তি লোপসহ উচ্চ রক্তচাপ, মাথাধরা, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তি বোধ, অনিদ্রা, হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।

নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক রঞ্জন বলেন, শব্দদূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। তাদের মানসিক বিকাশের অন্তরায় শব্দদূষণ। শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবেলের ওপরে হলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়।

নেত্রকোনা শহরে শব্দের মাত্রা ২০০ ডেসিবেলের ওপরে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এ ‘নীরব’, ‘আবাসিক’, ‘মিশ্র’, ‘বাণিজ্যিক’ ও ‘শিল্প’—এই পাঁচ এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিধিমালায় নীরব এলাকায় দিনে (ভোর ছয়টা থেকে রাত নয়টা) ৫০ ডেসিবেল ও রাতে (রাত নয়টা থেকে ভোর ছয়টা) ৪০ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫, রাতে ৪৫, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০, রাতে ৫০, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০, রাতে ৬০ ও শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫, রাতে হবে ৭০ ডেসিবেল।

বিধিমালায় শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম না করার শর্তে মাইক, অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধানও আছে, কিন্তু নেত্রকোনায় মাইকিংয়ের ক্ষেত্রে এ বিধান মানা হয় না।

পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহ কার্যালয়ের উপপরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এর ১৮ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বিধিমালার বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক এক মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযান পরিচালনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।