ইভিএমেও নিজের পছন্দে ভোট দিতে পারলেন না অনেকে

১. আশ্রাফাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে ভোটারের সঙ্গে ঢুকে পড়েন আরেকজন। ২. ছবি তুলছে, পেছন থেকে কেউ একজন বলার পর ঘুরে তাকান তিনি। ৩. এরপরই কালো কাপড় দিয়ে তৈরি গোপন কক্ষে মাথা নিচু করে ফেলেন তিনি। কামরাঙ্গীরচর চর, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: আবদুস সালাম
১. আশ্রাফাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে ভোটারের সঙ্গে ঢুকে পড়েন আরেকজন। ২. ছবি তুলছে, পেছন থেকে কেউ একজন বলার পর ঘুরে তাকান তিনি। ৩. এরপরই কালো কাপড় দিয়ে তৈরি গোপন কক্ষে মাথা নিচু করে ফেলেন তিনি। কামরাঙ্গীরচর চর, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: আবদুস সালাম

শেষ হলো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। এখন শুরু হয়েছে ভোটগণনা। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হওয়ায় ফলাফল পেতে খুব বেশি দেরি হওয়ার কথা নয়। তবে নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণার জন্য কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। তবে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল দ্রুত চলে আসবে। এ থেকেই প্রার্থীরা বুঝতে পারেন কার জয় হলো আর কার পরাজয় হলো।

আজ শনিবার সকাল আটটা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। চলে বিকেল চারটা পর্যন্ত। ইভিএমে একসঙ্গে ৫৪ লাখ ভোটারের ভোট গ্রহণ এটাই প্রথম। মেয়র, কাউন্সিল ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের তিনটি পদে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। ইভিএমে ভোট হওয়ায় এবার ব্যালটে সিল বা জাল ভোট দেওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু অনেকেই এবার নিজের ভোট নিজে দিতে পারেননি। ইভিএমে আঙুলের ছাপ দিয়ে মেশিনটি খোলা হলেও অনেক ভোটারকে নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়।

অবশ্য ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। আর অভিযোগ ছিল বিস্তর। সব অভিযোগই বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের। সরেজমিন ভোটকেন্দ্র ঘুরেও নানা অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে। ঢাকার বহু কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রের আশপাশে বিএনপির কর্মীদের উপস্থিতিও ছিল না। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতি ছিল সর্বত্র। কেন্দ্রের ভেতরে-বাইরে সব জায়গা ছিল তাঁদেরই নিয়ন্ত্রণে।

মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে নারীদের গোপন কক্ষে এক পুরুষ সদস্য ঢুকে জোর করে ভোট দেন। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাজিদ হোসেন
মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে নারীদের গোপন কক্ষে এক পুরুষ সদস্য ঢুকে জোর করে ভোট দেন। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাজিদ হোসেন

ভোটকে কেন্দ্র করে কয়েকটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে মারপিটের ঘটনা ঘটেছে। সাংবাদিকদের মারধর, তাঁদের সঙ্গে সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকদের খারাপ আচরণের কিছু ঘটনাও ঘটেছে। তা ছাড়া আঙুলের চাপ দেওয়ার পর ভোটারকে নির্দিষ্ট একটি প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বাটনে চাপ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা। ভোটকেন্দ্রের বাইরের চিত্র এক রকম হলেও কেন্দ্রের ভেতরের পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম। পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও ভোট দিতে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনাগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছিল না তারা। অনেক ভোটারকে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তর্ক করতে দেখে গেছে। ভোট না দিয়ে কেউ কেউ কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেছেন—এমন ঘটনাও ঘটেছে।

সকালে রাজধানীর সিটি কলেজে ভোট দেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি ইভিএমের প্রশংসা করেন।

নির্বাচনে উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চার প্রার্থীই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। উত্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও দক্ষিণের শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। বিএনপির নানা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, বিএনপির দুই প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন সুষ্ঠু ভোট হলে জয় পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তবে তাবিথ বলেছেন, সুস্থ ভোট হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন না।

মিরপুর গার্লস আইডিয়াল স্কুল কেন্দ্রে ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। মিরপুর ১০, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: আশরাফুল আলম
মিরপুর গার্লস আইডিয়াল স্কুল কেন্দ্রে ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। মিরপুর ১০, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: আশরাফুল আলম

অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ভোট ভালোই হচ্ছে। তবে সকালের দিকে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নিজের অসন্তুষ্টির কথা জানান।

বাটন চেপে ভোটটি দিল পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে আজ শনিবার বেলা একটার দিকে ভোট দিতে এসেছিলেন এক ব্যক্তি। কিছুক্ষণ পরে বুথ থেকে বের হয়েই চিৎকার শুরু করেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে ঘিরে কিছু মানুষ জড়ো হলো, একটা হইচই অবস্থা।

জানা গেল, ওই ব্যক্তি ভোট দেওয়ার সব কাজ করেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে আঙুলের ছাপও দিয়েছিলেন। তবে ভোট দেওয়ার বাটনে চাপ দিতে পারেননি, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি বাটন চাপ দিয়ে তাঁর ভোট দিয়ে দিয়েছেন। এমন কাজে হতবাক তিনি, বের হয়ে এসে অভিযোগ করতে থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি জানান, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন তাঁর ভোট বাটন চেপে দিয়ে দিয়েছেন।

সকাল থেকে বেশ কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। সূত্রাপুর কমিউনিটি সেন্টার কেন্দ্রটির ভেতরে আওয়ামী লীগের অন্তত ৮০ জন নেতা-কর্মী সকাল থেকেই অবস্থান নেন। সিটি কলেজ, আইডিয়াল স্কুল কেন্দ্রে গিয়েও দেখা যায় কোথাও বিএনপি–সমর্থিত কাউন্সিলর ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীর কোনো এজেন্ট নেই।

ঢাকা উত্তরের বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল সকালে গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভোট দেন। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ঢাকা উত্তরের বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল সকালে গুলশানের মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভোট দেন। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাইফুল ইসলাম

সংসদ ভবনের উল্টো দিকে রাজধানী স্কুলে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে জানান দুজন ভোটার। তাঁদের অভিযোগ সব প্রক্রিয়া মেষ করার পর বাটন চাপার সময় অন্য ব্যক্তি এসে ভোটারদের একটি প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করেন। ওই দুজন ভোটার জানান, এটা দেখে তাঁরা ভোট না দিয়েই চলে এসেছেন।

নির্বাচনে বিএনপির দুই মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেনও এ–সংক্রান্ত অভিযোগ নিজ নিজ এলাকার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দিয়েছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ভোটকেন্দ্রে ভোটারের সঙ্গে বুথের গোপন কক্ষে ঢুকছেন প্রার্থীর এজেন্টও। তবে এ বিষয়ে দায়িত্বরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেছেন, কেউ তাঁকে অভিযোগ করেনি।

রাজাবাজারের নাজনীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে নারীদের একটি কক্ষে এক নারী ভোটারকে ভোট দেওয়ার উপায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন দায়িত্বরত পোলিং কর্মকর্তা। তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন নৌকা ও লাটিম মার্কার এক নারী এজেন্ট। তিনি প্রথমে ভোটারের সঙ্গে গোপন কক্ষে ঢুকতে গেলে আরেক এজেন্ট সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে ইশারায় নিষেধ করেন। পরে ভোটার ভোটকক্ষে ঢুকলে ওই নারী এজেন্ট ভেতরে যান।

বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: মোশতাক আহমেদ
বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: মোশতাক আহমেদ

এ বিষয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলে বলেন, ভোটার সাহায্যের জন্য ডেকেছেন। কিন্তু সাহায্যের জন্য পোলিং এজেন্ট বা সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা না গিয়ে প্রার্থীর এজেন্ট কেন ঢুকলেন, জানতে চাইলে তাঁরা কোনো উত্তর দেননি।

বিষয়টি নিয়ে ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ফজলে রাব্বিকে জিজ্ঞেস করা হলে বলেন, ‘কেউ তো এসে অভিযোগ করেনি। আর আপনারা তো সবই জানেন।’

এ ছাড়া তেজগাঁও সরকারি কলেজ কেন্দ্রের ভেতরে প্রার্থীর পক্ষর এজেন্ট ছাড়াও প্রচুর লোকের সমাগম ছিল।

আমি ভোট পর্যবেক্ষণ করছি: রবার্ট ডিকসন
বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন বলেছেন, তিনি সিটি ভোট পর্যবেক্ষণ করছেন। নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না।

আজ রাজধানীর আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। পরিদর্শনকালে কেন্দ্রের তিনটি বুথ ঘুরে দেখেন তিনি।

তখন পর্যন্ত ৪ নম্বর বুথে ভোট পড়ে ৪১টি। ওই বুথে মোট ভোটার ৩৬০টি।

ঢাকা দক্ষিণে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন গোপীবাগের শহীদ শাহজাহান প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: হাসান রাজা
ঢাকা দক্ষিণে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন গোপীবাগের শহীদ শাহজাহান প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: হাসান রাজা

ভোটার সংখ্যা কম থাকার বিষয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনার প্রশ্ন করেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে। ওই কর্মকর্তা ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে বলেন, লাঞ্চের (দুপুর) পর ভোটার সংখ্যা বাড়তে পারে।

কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হাইকমিশনারের কাছে ভোট নিয়ে মন্তব্য জানতে চান সাংবাদিকেরা। তখন তিনি বলেন, ‘আমি পর্যবেক্ষণ করছি। নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না।’

কেন্দ্রে ভোটারের খরা
সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেছে, কিন্তু ভোটারের কোনো লাইন নেই। ভোট গ্রহণের কাজে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা বসে আছেন। মাঝেমধ্যে দু-একজন ভোটার উপস্থিত হন। ভোট দিয়ে চলে গেলে আবার অপেক্ষা করেন পরবর্তী ভোটারের জন্য। এই চিত্র রাজধানীর বেইলি রোড এলাকায় অবস্থিত সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ কেন্দ্রে।

সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ কেন্দ্রে মোট তিনটি কেন্দ্র রয়েছে। নিচতলায় অবস্থিত কেন্দ্রে তথ্য সংগ্রহ করে জানা গেল, দুপুর ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ভোট পড়েছে মাত্র ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ।

একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানালেন, তাঁর কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৩৫৮ জন। এখানে সবাই নারী ভোটার।

এক ভোটারের আঙুলে অমোচনীয় কালি। বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্র, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: আবদুস সালাম
এক ভোটারের আঙুলে অমোচনীয় কালি। বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্র, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: আবদুস সালাম

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতটি বুথে ভোট নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি বুথে ভোটার ৩৩৭ জন করে। এর মধ্যে ১ নম্বর কক্ষে ১২টা ৪ মিনিট পর্যন্ত ভোট পড়েছে ২৩টি। ২ নম্বর কক্ষে ভোট পড়েছে ২০টি। ৩ নম্বর কক্ষে ভোট পড়েছে ১৯টি। ৪ নম্বর কক্ষে ভোট দিয়েছেন ১৭ জন। ৫ নম্বর কক্ষে ১৬, ৬ নম্বর কক্ষে ৮ এবং ৭ নম্বর কক্ষে ১৯টি ভোট পড়েছে। শুধু এই কেন্দ্রেই নয়, আশপাশের কেন্দ্রগুলোতেও ভোটার উপস্থিতি খুবই কম।

ঢাকার এই নির্বাচনের খবর সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন প্রথম আলোর ৪৫ জন সাংবাদিক ও ফটোসাংবাদিক। পুরান ঢাকা, উত্তরা, মিরপুরসহ বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রের চিত্র ছিল প্রায়ই একই রকম। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। অবশ্য বেলা বাড়ার সঙ্গে ভোটার কিছুটা বাড়ে; যদিও তার পরিমাণও কম।

অনেকের আঙুলের ছাপ মিলছে না
বয়স্ক ও শ্রমজীবী মানুষের ইভিএমে ভোট দিতে বেশি অসুবিধা হচ্ছে। অনেকবার চেষ্টা করার পরও অনেকের আঙুলের ছাপ মিলছে না। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আঙুলের চাপও মেলেনি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মিরপুর উদয়ন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ইউসুফ আলী আজ সকাল আটটায় ভোটকক্ষ ৫-এ ভোট দিতে আসেন। পেশায় ঝালমুড়ি বিক্রেতা ইউসুফ কয়েকবার চেষ্টা করার পরও ভোট দিতে পারেননি। পরে আবার বেলা সাড়ে ১১টায় আসেন। তখনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মেলায় সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সহায়তায় ভোট দেন তিনি।

সকালে সুনসান সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র। বংশাল, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার
সকালে সুনসান সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র। বংশাল, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

এই কক্ষে মোট ভোটার সংখ্যা ৩৬৭। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৫৩টি। এর মধ্যে চারজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সহায়তায় ভোট দিয়েছেন। এ ছাড়া আরও চারজনকে হাত ধুয়ে আবার আসতে বলা হয়েছে। এই কেন্দ্রের অন্য বুথেও এমন অবস্থা।

হক পেদা (৫৩) ঝুটের কারখানায় কাজ করেন। তিনিও একই সমস্যায় পড়েছেন।

আবার মিরপুর আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ৭৩ বছর বয়সী এক নারী ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মেলায় ভোট না দিয়েই চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘এত ভোট দিছি। কোনো দিন এমন হয় নাই। এহন বুড়া বয়সে ভোট দিতে পারলাম না।’

এক প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেন, নারী, বয়স্ক ও শ্রমজীবী মানুষের ভোট দিতে বেশি সমস্যা হচ্ছে। শীতের কারণেও হয়তো আঙুলের রেখা মিলছে না।

ইভিএম মেশিন কাজ করছিল না। তাই ভোটকক্ষের সামনে ভোটারদের দীর্ঘ সারি। বাদশা ফয়সাল ইনস্টিটিউট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: জাহিদুল করিম
ইভিএম মেশিন কাজ করছিল না। তাই ভোটকক্ষের সামনে ভোটারদের দীর্ঘ সারি। বাদশা ফয়সাল ইনস্টিটিউট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: জাহিদুল করিম

বেশ কিছু কেন্দ্রে ভেসলিন লাগিয়ে, হাত ধুয়ে ও টিস্যু ব্যবহার করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলাতে চেষ্টা করতে দেখা গেছে।

বকশীবাজারে ককটেল বিস্ফোরণ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বকশীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী ও বিএনপির প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় আটটি ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। প্রায় ২০ মিনিট ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল।

এই কেন্দ্রে সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ–মনোনীত প্রার্থী ওমর বিন আবদাল আজিজ তামিম ও তাঁর সমর্থকেরা উপস্থিত ছিলেন। তিনি মিষ্টিকুমড়া মার্কায় দাঁড়িয়েছেন। সকাল থেকেই তাঁর সমর্থকেরা তাঁতখানা লেনে দাঁড়িয়েছিলেন। বেলা ১১টা ৪৭ মিনিটের দিকে এই ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী শাহেদা মোরশেদের সমর্থকেরা কেন্দ্রের পেছনে নাজিমুদ্দিন রোডের দিকে উপস্থিত হন। তাঁরা কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ সময় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীদের দিকে বিএনপির সমর্থকেরা ঢিল ছুড়লে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষের মধ্যে ঢিল ছোড়াছুড়ি শুরু হয়। দুজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে দেখা যায়। এ সময় আটটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। কেন্দ্রে তখন ভোটারদের বড় একটি লাইন ছিল। ভোটাররা দিগ্‌বিদিক ছুটে যান। ভোট গ্রহণ কিছুক্ষণ বন্ধ ছিল।

বকশীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: ছবি: আহমেদ দীপ্ত
বকশীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: ছবি: আহমেদ দীপ্ত

প্রত্যক্ষদর্শী আতাউর রহমান বলেন, ‘বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকেরা প্রথমে ককটেল ফাটায়। একটার পর একটা। কাউন্সিলর তামিমের চাচাতো ভাই জিনাত আলী জিন্নুকে ইট মেরে তারা আহত করে। পুরো এলাকা থমথমে করে ফেলছে। সুষ্ঠু পরিবেশে এখনো কেউ ভোট দিতে পারেনি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী শাহেদা মোরশেদ বলেন, ‘আমার ছেলেরা এগুলো কিছু করেনি। আমরা আতঙ্কে ছিলাম। ওরা আমাদের আগে ইট মেরেছে। ককটেলের আওয়াজ পেয়েছি আমরা। এভাবে চললে কীভাবে আমরা ভোট দেব।’

এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এদিকে ঝামেলা হয়েছিল। ভোট গ্রহণ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি বুঝে আবার ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে।

ঘটনার পরপরই চলে আসেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাসিনা ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সকাল থেকেই এই কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে বহিরাগতদের অনেক আনাগোনা ছিল। তবে আমাদের মূল চিন্তা ভোটকেন্দ্র। কেন্দ্রের ভেতরের অবস্থা ঠিক আছে। বাইরের বিষয়টা হলো প্রার্থীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। দুপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। একে অন্যকে দোষ দিচ্ছে।’

কেন্দ্রে এসে বিরোধী দলের এজেন্ট খুঁজলেন মাহবুব তালুকদার
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আজ শনিবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে এসে বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থীর এজেন্টদের খুঁজলেন। তিনি আজ সকালে স্ত্রীকে নিয়ে ইস্পাহানি বালিকা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে ভোট দিতে আসেন। প্রায় ৪৫ মিনিট কেন্দ্রটিতে অবস্থান করে ভোট দেখেন।

গোপন ভোটকক্ষে ভোটারকে জোর করে ভোট দেওয়াচ্ছেন এক ব্যক্তি। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: জাহিদুল করিম
গোপন ভোটকক্ষে ভোটারকে জোর করে ভোট দেওয়াচ্ছেন এক ব্যক্তি। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: জাহিদুল করিম

একপর্যায়ে ৪ নম্বর বুথে ভোট দিতে এসে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুসকে পুরো কেন্দ্রে বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থীর এজেন্টদের খুঁজতে বলেন মাহবুব তালুকদার। নির্বাচন কমিশনার প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে বলেন, ‘পুরো কেন্দ্রে বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট আছে কি না খুঁজে দেখো।’

কেন্দ্রটি ছেড়ে যাওয়ার আগে মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো কোনো এজেন্ট খুঁজে পেলাম না, তাই বের করে দেওয়ার কথা আসছে কেন? আপনারা বলছেন, সকালে এজেন্ট ছিল। এখন নেই। আপনারা খুঁজে বের করেন, কেন নেই।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০৪৪ নম্বর কেন্দ্রটিতে ৪ বুথে ১ হাজার ৮০৫ ভোটার রয়েছেন। দুপুর ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত ভোট পড়েছে ২২২টি।