দুর্বল বিএনপি নিজের ভোটও হারাচ্ছে

টানা প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। রাজনীতির মাঠেও অনেকটাই কোণঠাসা বারবার ক্ষমতায় থাকা দলটি। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দিয়ে ব্যর্থ হওয়া এবং এর পরের বছর ২০১৫ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক দফা দাবির আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার পর রাজনীতির মাঠে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে বিএনপি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হওয়াটা (ব্যতিক্রম সিলেট) যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে দলটির কাছে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিটি নির্বাচন। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয় পায় দলটি। এ ছাড়া সব নির্বাচনেই হেরেছে বিএনপি। হারার পর সরকারি দলের কারচুপি, হামলা–মামলা, কর্মীদের দাঁড়াতে না দেওয়া, কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে বাধা দেওয়া, ভোটারদের আসতে না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ তোলে বিএনপি। কিন্তু এখন আলোচনায় আসছে শুধু সরকারি দলের কারণেই কী নির্বাচনে হারছে বিএনপি, নাকি নিজেদের ব্যর্থতাও রয়েছে।

বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এই নির্বাচনে সাংগঠনিক কী ধরনের দুর্বলতা ছিল, কোথায় কোথায় ব্যর্থতা রয়েছে, সেসব সংশোধনের কাজ করতে চায় দলটি।

রাজনীতি বিশ্লেষক ও বিএনপির নেতারা মনে করছেন, বিএনপিকে সরকার, পুলিশ, প্রশাসন এবং সরকারদলীয় নেতা–কর্মীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এতগুলো শক্তির সঙ্গে ‘লড়াই’ করা বিএনপির জন্য দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। কিন্তু তারপরও ভোটাররা তাদের সঙ্গে আছেন। কিন্তু দল হিসেবে বিএনপির সাংগঠনিক ব্যর্থতা, ভোটারদের উজ্জীবিত করতে না পারা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পেছনে কাজ করছে। তারা মনে করেন, নিজের ভোটাররাই বিএনপির ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। এ কারণে ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন না। এই সুযোগটাই নিচ্ছে সরকারি দল। সিলেটে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী তাঁর কর্মীদের নিয়ে মাঠে সব প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ করতে পারায় জয় পেয়েছেন। এই কাজটি অন্যান্য জায়গার ভোটে দেখা যায়নি।

ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে বিএনপিরও দায় আছে বলে মনে করেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। তা হচ্ছে ভয়ের সংস্কৃতি স্থায়ী করার জন্য সরকার নিপীড়নমূলক যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সে ভয়ের সংস্কৃতি থেকে কাছের নেতা–কর্মীদের বাইরে অন্য কাউকে বিএনপি উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। কর্মীদের বোঝাতে পারেনি যে এটা ভয় না, এটা মেকি ভয়। তিনি বলেন, ‘এই মোটিভেশন তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। তা ছাড়া, হত্যা, গুম, মামলা, হয়রানির চিত্র মানুষ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেখেছে। সেই ভয়ও মানুষের মধ্যে কাজ করেছে।’

বিভিন্ন সময়ের বিএনপির ভোটের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জাতীয় নির্বাচনে দলটি গড়ে ৩২ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেয়েছে। অবশ্য ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দলটি মাত্র ১০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিএনপির নিজস্ব যে ‘ভোটব্যাংক’ আছে সেই পরিমাণ ভোট দলটি এখন আর পাচ্ছে না। এর মানে এই নয় যে বিএনপির ভোট কমে গেছে। কিন্তু ভোটাররা এখন কম সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন। এর পেছনে সরকারদলীয়দের ভয়ভীতি যেমন আছে, তেমনি দল হিসেবে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাও দায়ী।

এবারের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ৫৪ লাখের বেশি। এর মধ্যে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি ভোট পড়েছে। বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থী ৫ লাখ ৬৭৩ ভোট পেয়েছেন, যা প্রদত্ত ভোটের ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ এ হিসাবে রাজধানীর মোট ভোটারের মাত্র ৯ শতাংশ বিএনপিকে ভোট দিয়েছেন। এ থেকে পরিষ্কার, ঢাকায় বিএনপির নিজস্ব যে ভোটার আছেন, সেই ভোটাররা পর্যন্ত ভোট দিতে যাননি। বিএনপির নেতারা অবশ্য বলছেন, তাঁদের অনেক ভোটারকে সরকারদলীয়রা কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছেন। অথবা ‘অন্য’ প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করেছেন। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয় বলে মানেন দলটির নেতারা।

এবারের নির্বাচনে বিএনপির জনপ্রিয়তা নতুন করে বোঝা গেছে বলে মনে করেন দলের আরেক যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেখানে আমরা মিছিল, মিটিং সমাবেশ করার ন্যূনতম পরিবেশ পাই না, সেখানে এই নির্বাচনে দুই প্রার্থীর পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। নেতা–কর্মীরা কাজ করতে পেরেছেন। বিএনপি যে জনপ্রিয় দল, তা নতুন করে বোঝা গেছে।’ তবে এই নেতাও মনে করেন, তাঁদের যে জনপ্রিয়তা, তা ভোটে প্রমাণ করতে হবে। সে জন্য ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে, তাঁদের সাহস জোগাতে বিএনপিকে কাজ করতে হবে। কর্মীদের পাশে আরও নিবিড়ভাবে থাকতে হবে।

ঢাকায় হেরেও লাভ দেখছে বিএনপি
ঢাকার সিটি নির্বাচনে হেরে গেলেও এতে কয়েকটি দিক দিয়ে বিএনপি নিজেদের লাভবান মনে করছে। দীর্ঘদিন পর মাঠের রাজনীতিতে দলের নেতা–কর্মীদের সক্রিয় করতে পারা, তরুণ দুই মেয়র প্রার্থীর জনপ্রিয়তা যাচাইকে অন্যতম অর্জন বলছে দলটি। এ ছাড়া বিএনপির নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়া এবং ইভিএমেও কারচুপির সুযোগ মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

বড় ব্যবধানেই ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বিএনপি থেকে মনোনীত তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে হেরেছেন। নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করে তাঁরা রোববার ঢাকায় হরতালও পালন করেছেন। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, ঢাকার নির্বাচন থেকে বিএনপির নতুন করে হারানোর কিছু নেই। চট্টগ্রাম-৮ আসনে ইভিএম প্রযুক্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমেই বিএনপির বুঝতে পেরেছে ঢাকায় কী হতে পারে। ঢাকার মতো স্থানে মেয়রের পদে আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচন করবে, সেটা বিএনপি আশাও করেনি।

দুটি অর্জনকে বিএনপি বড় করে দেখছে। দীর্ঘদিন পর নেতা-কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নেমেছেন। নির্বাচনের আগে অবশ্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাস্তায় বের হয়ে আসতে পারাটাই তাঁদের বড় মুনাফা। বিএনপির সাংগঠনিক পর্যায়ের নেতারাও সেটাই মনে করছেন। এক সাংগঠনিক নেতা প্রথম আলোকে ২০১৪ বা ২০১৫ সালের কর্মসূচিতে সারা দেশ সাড়া দিয়েছিল কিন্তু ঢাকায় বিএনপি তেমন কিছু করতে পারেনি। ঢাকা তখনো নীরব ছিল। এরপর ঢাকাকে উজ্জীবিত করার ও রকম কোনো সুযোগও হয়নি। কিন্তু ঢাকার সিটি নির্বাচনে দুই প্রার্থীর পক্ষে নেতা–কর্মীরা ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছিলেন।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার একত্র হয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কিছু করা বা মিছিল সমাবেশ করার সুযোগ পেয়েছি। এ কাজগুলো যে আমরা করতে পেরেছি, তাতে মনে করি যে ঢাকায় আন্দোলনের মাঠ প্রস্তুত করার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এটাকে আরও সুসংগঠিত করে ইচ্ছা করলে কাজে লাগানো যাবে।’

তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেনকে নিয়েও সন্তুষ্ট বিএনপির নেতারা। তাঁরা নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছেন বলে মনে করছে দল। দলের নেতারা বলছেন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দলে দুজন তরুণ শিক্ষিত নেতা পাওয়া গেছে, যাঁদের নিয়ে বিএনপি আশাবাদী। ভবিষ্যতের জন্য এ দুজন তরুণকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পেরেছে, এটাকে বড় অর্জন বলে মনে করছে বিএনপি। এদের নিয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘মানুষের মধ্যে তাঁদের নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। দুজনের মধ্যেই দেখেছি যে তাঁদের মধ্যে নতুনত্ব আছে। সবার সঙ্গে খুব সহজে তাঁরা মিশতে পেরেছেন। এটা রাজনীতিতে বড় গুণ।’ খায়রুল কবিরও মনে করেন, তাবিথ ও ইশরাক নিজেদের একটা অবস্থান তৈরি করে ফেলেছেন। বিএনপির নেতারা জানান, তাবিথ ও ইশরাক যদি দলে নিয়মিত সক্রিয় অংশ নেন, তাহলে শীর্ষ নেতৃত্বও তাঁদের নিয়ে সামনে আরও ভাববে।

সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে চলছে ভোট গ্রহণ। বংশাল, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার
সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে চলছে ভোট গ্রহণ। বংশাল, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

ঢাকার সিটি নির্বাচন হয়েছে ইভিএম পদ্ধতিতে। বিএনপি শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে এসেছিল। নির্বাচন শেষে বিএনপি বলছে, ইভিএমেও যে ভোট সুষ্ঠু হবে না, তা প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে না, তা বিএনপি বারবার বলে এলেও এবার সেটা আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হতাশাজনক ভোটার উপস্থিতি তারই প্রমাণ।

নিজেদের অর্জনের প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নেতা–কর্মীরা রাস্তায় নামতে পেরেছেন। ধানের শীষের স্লোগানকে ঢাকাবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি। দুই সিটিতে দুজন নতুন প্রজন্মের নেতা সৃষ্টি করতে পেরেছি। আওয়ামী লীগ ও ইসির অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, তা প্রমাণ করতে পেরেছি। এটা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিশাল ভূমিকা রাখবে। এসব আমাদের বড় অর্জন।’ ইভিএমের সমালোচনা করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘নিজেরা নিজেরা টিপে ভোট দিয়েও তো ৩০ শতাংশের বেশি ভোট ওঠাতে পারেনি। সরকারি দলকে জেতানোর জন্য নির্বাচন কমিশন বিতর্কিতভাবে ইভিএম ব্যবহার করল, সেটা জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়েছে।’

কেন্দ্রগুলোতে বিএনপির এজেন্টের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। কেন্দ্রে তাঁদের না থাকা নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে। তবে বিএনপির অভিযোগ, মারধর করে এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে এবং ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে এজেন্টদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন সাংগঠনিক নেতা জানান, এজেন্টদের আগে থেকেই ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। কেন্দ্রে গেলে ‘পরে দেখে নেওয়া হবে’ বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। সে কারণে তাঁরা কেন্দ্রে যেতে পারেননি বা অনেকে যাননিও। এ ছাড়া এজেন্টদের এই শহরেই থাকতে হবে, নিরাপত্তা শঙ্কাও অনেকের মধ্যে কাজ করেছে।