বৌদ্ধ ভিক্ষুর সেই সেতু চালু

এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর উদ্যোগে সাধারণ মানুষের দানের টাকায় বানানো এই সেতু গত বুধবার চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের বড়ুয়াপাড়া এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর উদ্যোগে সাধারণ মানুষের দানের টাকায় বানানো এই সেতু গত বুধবার চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের বড়ুয়াপাড়া এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

প্রশাসনের কাছে বছরের পর বছর ধরে সেতুর দাবি জানিয়েও কাজ হয়নি। তাই এক বছর আগে দানের টাকায় সেতু বানানো শুরু করেছিলেন এক বৌদ্ধ ভিক্ষু। ‘স্বপ্নের’ সেই সেতু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে অবশেষে। এই এক সেতুতেই হাসি ফুটেছে দুই গ্রামের ১৫ হাজার মানুষের মুখে। জনদুর্ভোগ লাঘবে ব্যক্তি উদ্যোগে সেতু নির্মাণের এই নজির সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজানে।

গত বুধবার রাউজানে বৌদ্ধ ভিক্ষু পঞ্ঞ চক্ক মহাথেরের উদ্যোগে নির্মিত ১ হাজার ৪৬৫ ফুট দীর্ঘ ও ৫ ফুট প্রস্থের সেতুটির ওপর দিয়ে মানুষজন চলাচল শুরু করেছে।

স্থানীয় মানুষজন বলছেন, সেতু হওয়ায় মানুষজনের চলাচলের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন কৃষকেরা। তাঁরা এখন সহজে কৃষিকাজে ব্যবহৃত মালামাল, সবজি ও ধান আনা–নেওয়া করতে পারবেন।

সেতুটি যুক্ত করেছে উপজেলার পাহাড়তলী ও কদলপুর ইউনিয়নকে। গত বছরের ৩১ মার্চ প্রথম আলোতে ‘দানের টাকায় সেতু বানাচ্ছেন বৌদ্ধ ভিক্ষু’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর দেশ-বিদেশের অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি সেতুর কাজে সহায়তায় এগিয়ে আসেন।

বুধবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুটির ওপর দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা চলাচল করছে। তবে সেতুটির দুপাশে বেষ্টনী নির্মাণের কাজ বাকি আছে। ২০ লাখ টাকার ব্যবস্থা হলে বেষ্টনীটি হয়ে যাবে বলে জানান এই ভিক্ষু। স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে সেতু দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন কদলপুর গ্রামের অনামিকা বড়ুয়া। তিনি বলেন, আগে চার কিলোমিটার পথ ঘুরে আত্মীয়ের বাড়িতে যেতে হতো। সেতু হওয়ায় এখন আধা কিলোমিটার হেঁটেই সেখানে যেতে পারছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাশাপাশি দুই ইউনিয়নের মধ্যে দূরত্ব ৩০০ মিটার। ইউনিয়ন দুটিকে এত দিন পৃথক করে রেখেছিল বিস্তীর্ণ ধানখেত আর ডোবা, যা বছরের বেশির ভাগ সময় ডুবে থাকে পানিতে। ফলে এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নে যেতে ১৫ হাজার বাসিন্দাকে ঘুরতে হতো প্রায় চার কিলোমিটার পথ। সেতু নির্মাণের জন্য বছরের পর বছর থেকে ধরনা দিয়ে আসছিলেন তাঁরা। কিন্তু সরকারি কোনো দপ্তর বা জনপ্রতিনিধি কেউই সাড়া দেননি। স্থানীয় মানুষের কষ্ট লাঘবে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ চালানোর উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসেন খৈয়াখালী উচ্চবিদ্যালয় ও খৈয়াখালী ধম্মা বিজয়া রামবিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি পঞ্ঞ চক্ক মহাথের। এই সেতু বানাতে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। সেতু নির্মাণে ১২০ শ্রমিকের পাশাপাশি নিয়মিত প্রায় ১০০ যুবক-তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেছেন।

>দানের টাকায় করা ১ হাজার ৪৬৫ ফুট সেতুটি উন্মুক্ত হলো। দুর্ভোগ লাঘব ১৫ হাজার বাসিন্দার।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক পঞ্ঞ চক্ক মহাথের জানালেন, সেতু নির্মাণে সরকারি বরাদ্দ পাওয়া না গেলেও স্থানীয় লোকজন অর্থসহায়তা দিয়েছেন। তবে কারও কাছ থেকে চেয়ে টাকা নেওয়া হয়নি। স্বেচ্ছায় যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের টাকা নেওয়া হয়েছে। সেতুর নাম দেওয়া হয়েছে খৈয়াখালী-কদলপুর সংযোগ সেতু।

 পঞ্ঞ চক্ক মহাথের বলেন, কদলপুর থেকে পাহাড়তলী ইউনিয়নের খৈয়াখালী উচ্চবিদ্যালয় ও খৈয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগে শিক্ষার্থীদের। সেতু চালু হওয়ায় লাগবে মোটে ১০ থেকে ১৫ মিনিট।

বিনা পারিশ্রমিকে সেতুটির নকশা করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী উৎপল বড়ুয়া। বুধবার বিকেলে সেতু এলাকায় গিয়ে পাওয়া গেল তাঁকেও। তিনি বলেন, একটি ভালো কাজের অংশ হতে পেরেছেন, এ জন্য গর্বিত।

স্বেচ্ছায় শ্রম দেওয়া কলেজপড়ুয়া তরুণ নিশান চৌধুরী বলেন, ভালো কাজে শ্রম দিতে পেরে আনন্দিত।

পাহাড়তলী ইউপি চেয়ারম্যান রোকন উদ্দিন বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগে এত দীর্ঘ একটি সেতু বানানো কঠিন কাজ। এটি দেশের জন্য বিরল কর্মযজ্ঞ।

স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের রাউজান উপজেলা প্রকৌশলী আবুল কালাম বলেন, এই সেতু নির্মাণের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ভোগ লাঘব হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি এ ধরনের উদ্যোগ অন্যান্য স্থানেও সৃষ্টি হলে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা আরও উন্নত হবে।