সাবেক প্রকৌশলীর সংগ্রহশালায় সুলতানি-মোগল আমলের মুদ্রা

নূরুল ইসলাম
নূরুল ইসলাম

সাদা রঙের আটপৌরে ভবনটার সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠতেই বিড়ালছানা তিনটি চোখে পড়ল। দরজার সামনে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। নূরুল ইসলাম আদর করে ছানাগুলোকে সরিয়ে দিলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে খুললেন সুবিশাল দরজাটি। ভেতরে পা রাখতেই যেন হারিয়ে গেলাম কয়েক শ বছর আগের দুনিয়ায়।

হাজার বছরের পুরোনো দুর্লভ সব মুদ্রা আর ডাকটিকিটে সাজানো সমৃদ্ধ এক সংগ্রহশালা। শোকেসে সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মুদ্রাগুলো। একেকটা মুদ্রা যেন ইতিহাসের আকর। প্রতিটার পেছনে আছে নানা যুগের নানা মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক অবস্থান ও সমাজচিত্রের চমকপ্রদ সব গল্প। সে গল্পই অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন নব্বই পার হওয়া মানুষটি। সেই ছোটবেলা থেকে মুদ্রা আর ডাকটিকিট জমানোর শখ তাঁর। এখনো সেই শখে খাদ জমেনি এতটুকু। এই বয়সী অনেকে যেখানে চলতে–ফিরতে পারেন না, সেখানে এই মানুষটি ব্যতিক্রম। তিনি নূরুল ইসলাম, সাবেক প্রকৌশলী।

সমৃদ্ধ সংগ্রহ

বিশ্বের নানা দেশ থেকে সংগৃহীত দুর্লভ সব মুদ্রা ও ডাকটিকিট দিয়ে নূরুল ইসলাম নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন সংগ্রহশালাটি। আড়াই হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে সংগ্রহশালায় আছে সাড়ে ৫ হাজার মুদ্রা, আর কয়েক হাজার ডাকটিকিট। ভারতবর্ষের প্রাচীন যুগ থেকে এ সময় পর্যন্ত প্রায় সব রাজা, সম্রাট ও শাসকদের শাসনামলের মুদ্রা আছে এখানে। তাঁর সংগৃহীত মুদ্রা নিয়ে দেশ–বিদেশের গবেষকেরা গবেষণা করেন। 

এখানে দেখা মিলবে খ্রিষ্টপূর্ব প্রাচীন গ্রিসের অজেয় যোদ্ধা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, পারস্যের সম্রাট সুলতান মাহমুদ, ভারতবর্ষ আক্রমণকারী তৈমুর লং, খলিফা হারুন অর রশীদ, ময়ূর সিংহাসন লুণ্ঠনকারী নাদির শাহ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পৃথিবীর প্রায় এক–চতুর্থাংশ জায়গা দখল করে নেওয়া চেঙ্গিস খানের শাসনামলের মুদ্রা। 

আছে বিশ্বের প্রথম ডাকটিকিট ‘পেনি ব্ল্যাক’, ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক প্রকাশিত তিনটি ডাকটিকিটের সেট, ফোর্ট উইলিয়ামের দাপ্তরিক নথি, বিভিন্ন মূল্যবান পাথরসহ আরও অমূল্য সব সংগ্রহ। 

ইতিহাসের আকর

রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ের কমিশনার গলিতে নূরুল ইসলামের বাড়ি। ভবনের তৃতীয় তলায় জাদুঘরের আদলে সংগ্রহশালাটি গড়ে তুলেছেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশের যে ইতিহাস, তার কালক্রম অনুসারে সাজানো হয়েছে মুদ্রাগুলো। সংগ্রহশালার উত্তর অংশে আছে প্রাচীন ভারতের শাসকদের মুদ্রা। দক্ষিণ অংশটি সাজানো হয়েছে মধ্য ও আধুনিক যুগের শাসকদের মুদ্রা ও ডাকটিকিট দিয়ে।

চোখে পড়ে সংগ্রহশালার সবচেয়ে প্রাচীন মুদ্রাটির দিকে। প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো মুদ্রাটি প্রাচীন ভারতের শিশুনাগ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা শিশুনাগের আমলের। কাচের শোকেসে সাজানো প্রাচীন বাংলার বঙ্গ ও সমতট অঞ্চল শাসন করা রাজভট্টের রৌপ্যমুদ্রারও দেখা মিলল। নূরুল ইসলাম দাবি করলেন, রাজভট্টের এই মুদ্রা ব্রিটেনের জাদুঘরেও নেই। এই অংশেই আছে ভারতবর্ষ আক্রমণকারী সুলতান মাহমুদ গজনীর শাসনামলের একাধিক মুদ্রা।

সংগ্রহশালার মধ্য ও আধুনিক যুগের অংশটুকু ভাগ করা হয়েছে সুলতানি আমল, মোগল শাসনামল, ব্রিটিশ শাসনামল এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল—এই কয়েকটি ভাগে। সুলতানি আমলের ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি থেকে বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান কররানির শাসনামলের মুদ্রা সাজানো আছে এখানে। একইভাবে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর থেকে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত সব মোগল সম্রাটের শাসনামলের মুদ্রাও পাওয়া যাবে এখানে। এ ছাড়া বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, মহীশুরের রাজা টিপু সুলতান, লর্ড ক্লাইভ থেকে রানি ভিক্টোরিয়া ও রাজা ষষ্ঠ জর্জের শাসনামলের মুদ্রাও চোখে পড়ে।

এই সংগ্রহশালার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাচের শোকেসে সাজানো প্রতিটি মুদ্রার ওপর দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়েছে সেই শাসনামলের শাসকদের ছবি। এ ছাড়া কাগজে বড় আকারে ছাপানো হয়েছে মুদ্রার অনুলিপি, যাতে করে দর্শনার্থীদের দেখতে ও বুঝতে সুবিধা হয়।

শিক্ষণীয় ‘জ্ঞানকেন্দ্র’

সম্প্রতি নূরুল ইসলামের এই সংগ্রহশালা পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। পরিদর্শন বইতে তিনি লিখেছেন, ‘নানা যুগের মুদ্রার এমন ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। দারুণ যত্নসহকারে তিনি তাঁর আজীবনের স্বপ্ন মেলে ধরেছেন এই সংগ্রহশালায়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বুঝতে এই সংগ্রহশালা খুবই কাজে লাগবে বলে আমার বিশ্বাস। তরুণ প্রজন্মের জন্য এই সংগ্রহশালা খুব শিক্ষণীয় একটা জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে, সেই প্রত্যাশাই করছি।’

এই সংগ্রহশালা দেখে ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন পরিদর্শন বইয়ে লেখেন, ‘নূরুল ইসলামের সংগ্রহ ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশে খুব কম সংগ্রাহকের সংগ্রহ এত সমৃদ্ধিশালী। এই সংগ্রহের বৈশিষ্ট্য উপমহাদেশের প্রায় সব রাজা, সম্রাটের মুদ্রা। নূরুল ইসলামের সংগ্রহশালা যেন অটুট থাকে, সেটি দেখা আমাদের কর্তব্য।’

নূরুল ইসলাম জানান, জায়গার স্বল্পতার কারণে সবকিছু একসঙ্গে প্রদর্শন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাঁর সংগৃহীত মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগরসহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক। 

ব্যক্তিজীবন

নূরুল ইসলামের জন্ম ১৯৩০ সালে, হাওড়ায়। পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে। বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। পড়াশোনা করেছেন হাওড়া জিলা স্কুল ও শিবপুর দীনবন্ধু ইনস্টিটিউটে। দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। প্রকৌশলবিদ্যার পাট চোকান ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে।

নব্বই বছর বয়স পার করেও মুদ্রা সংগ্রহের জন্য নূরুল ইসলাম নিয়মিত খোঁজ রাখেন বিশ্বের নানা প্রান্তে এ–সংক্রান্ত নিলাম অনুষ্ঠানগুলোর দিকে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে কিংবা প্রতিনিধি মারফত সেই নিলামে অংশ নেন। সংগ্রহশালায় হঠাৎ চোখ পড়ে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সেনা অভিযান চালানো সুলতান সালাহউদ্দিনের একটা ছবির দিকে। ছবিটি এখনো টাঙানো হয়নি। নূরুল ইসলাম জানান, কিছুদিন আগে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত একটি নিলামে তিনি অনলাইনে অংশ নেন। ওই নিলাম থেকে সালাহউদ্দিনের আমলের একটি মুদ্রা তিনি সংগ্রহ করেন দেড় লাখ টাকায়।

পরিচালক হিসেবে বাবার সংগ্রহশালাটি দেখভাল করছেন নূরুল ইসলামের বড় মেয়ে ফাহিমা ইসলাম। বাবার ‘সংগ্রহ বাতিক’ নিয়ে গর্বিত এই মেয়ে বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সবাই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু বাবার এই চর্চার কারণেই আমরা সবাই ইতিহাসমনস্ক হয়েছি, যা সবার জন্যই জরুরি বলে আমি মনে করি।’

নূরুল ইসলাম জানান, কেবল সংগ্রহশালার অবকাঠামো তৈরি করতেই তাঁর এক কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এখনো অনেক কাজ বাকি। তবে এ মুহূর্তে তাঁর আর টাকা খরচের সংগতি নেই। এ অবস্থায় পর্যটন করপোরেশন যদি সংগ্রহশালাটি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেয়, টিকিটের বিনিময়ে পরিদর্শনের একটা ব্যবস্থা করে, তাহলে হয়তো এর একটা ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হয়।