একজন 'মুক্তিযোদ্ধার' আকুতি

আবদুর রাজ্জাক।
আবদুর রাজ্জাক।

সাবেক ধর্মমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার কথা স্বীকার করে নালিতাবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাকের দেশপ্রেম অতি প্রসংশনীয় উল্লেখ করে প্রত্যয়নপত্র দেন। কিন্তু বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তিনি কোনো স্বীকৃতি পাননি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে চান ৭০ বছরের মানুষটি।

শুধু সাবেক মন্ত্রী নন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুর রাজ্জাকের অসামান্য অবদানের কথা জানিয়ে লিখিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সেক্টরে থাকা আট মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরাও।

আবদুর রাজ্জাক ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নালিতাবাড়ী উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনী আবদুর রাজ্জাকের চাচা শামসুল হককে পৌর শহরের তারাগঞ্জ মধ্যবাজারে গুলি করে হত্যা করে। আবদুর রাজ্জাক ছিলেন তরুণ। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ ঠেকাতে স্থানীয় রাজাকাররা ছিল তৎপর। তাদের প্ররোচনায় পাকিস্তানি বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন আবদুর রাজ্জাক। হত্যা করার জন্য পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে খুঁজতে থাকে।

চাচাকে হত্যার ক্ষোভে আবদুর রাজ্জাক নাকুগাঁও হয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ঢালুতে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাব–সেক্টরে প্রশিক্ষণ নিতে যান। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর স্থানীয় ভারতীয়রা তাঁকে পাকিস্তানি বাহিনীর গুপ্তচর ভাবেন। তাই আবদুর রাজ্জাককে তাঁরা মারধর করেন। এ সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে উদ্ধার করেন। তখন তিনি প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যেতে চান। কিন্তু প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে রান্নার লোকের সংকট থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের পরামর্শে আবদুর রাজ্জাককে সাব-সেক্টরে বাবুর্চির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, সাব-সেক্টরে আবদুর রাজ্জাক প্রতিদিন ভোরে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রুটি ও চা তৈরি করতেন। সকালের নাশতা তৈরি করে রেশনের জন্য যেতেন বারেঙ্গাপাড়া বাজারে। দুপুরে ও রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাত ও সবজি রান্না করতেন। তাঁর রান্না করা খাবার খেতেন ৭০ থেকে ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। এ কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ সরবরাহ করতেন। ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে সহযোগিতার কথা জেনে যায় রাজাকাররা। তারা দেশে থাকা তাঁর বাবাকে হুমকি–ধমকি দেওয়া শুরু করে। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে মা–বাবার এ অসহায়ত্বের কথা জেনেও আবদুর রাজ্জাক দেশের স্বার্থে বাড়িতে ফেরেননি।

স্বাধীনতার পর আবদুর রাজ্জাক দেশে এসে নানা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন এবং তিনি রাজধানীতে রিকশা চালাতেন। ২০১০ সালে তাঁকে নকলা উপজেলার হাজি জাল মামুদ কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও ঢালু ১১ নম্বর সেক্টরের এফএফ কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা আবদুল হক চৌধুরী তাঁর মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় সহযোগিতা ও বাবুর্চির দায়িত্বে থাকার কথা স্বীকার করে একটি প্রত্যয়নপত্র দেন। এ ছাড়া ২০১৭ সালে তখনকার ধর্মমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বাবুর্চি হিসেবে কাজ করা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার কথা স্বীকার করে, আবদুর রাজ্জাকের দেশপ্রেম অতি প্রশংসনীয় উল্লেখ করে প্রত্যয়নপত্র দেন। তবু তিনি এখনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে।

স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য অনেকের কাছে অনুরোধ করেন আবদুর রাজ্জাক। সম্প্রতি তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে স্বীকৃতি পেতে আবেদনও করেছেন।

আবদুর রাজ্জাক বলেন, পায়ের হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে। হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়। সপ্তাহে ৪০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয় তাঁর। ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করে যা পান, তা দিয়ে কোনোমতে দিন চলে যায়। তিনি বলেন, ‘তবু কষ্ট নেই আমার। জীবনের শেষকালে এসে যদি কাজের স্বীকৃতিটা পেতাম, তাহলে শান্তিতে মরতে পারতাম।’

নালিতাবাড়ীর অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম জানান, আবদুর রাজ্জাক মূলত প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গিয়েছিলেন। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের পরামর্শে তাঁকে বাবুর্চির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ৯ মাস ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করেছেন।

ইউএনও আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমার মাধ্যমে তিনি (আবদুর রাজ্জাক) স্বীকৃতি চেয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। আমি তাঁর আবেদন পাঠিয়েছি। বিষয়টি যাচাই–বাছাই করে স্বীকৃতি দেওয়া হলে তাঁকে জানানো হবে।’