জিতবে না জেনেও চট্টগ্রামের ভোটে থাকতে চায় বিএনপি

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির মেয়র পদে দুই প্রার্থীই পরাজিত হন। ফাইল ছবি
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির মেয়র পদে দুই প্রার্থীই পরাজিত হন। ফাইল ছবি

পশ্চিমবঙ্গের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার নাম ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?’—এমন দ্বিধাগ্রস্ত এখন বিএনপিও। আর এ যাওয়াটা হলো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি ভোটের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এ নির্বাচন ঘিরে তোড়জোড় শুরু হয়েছে বন্দরনগরীতে। নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেওয়া বা না নেওয়া নিয়ে দলটির মধ্যে নানা মত দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম সিটির নেতা-কর্মীর মধ্যে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহ যথেষ্ট। তাঁরা আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ দিতে চান না। দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে ভিন্ন অবস্থান আছে। কেউ বলছেন, নির্বাচনী ব্যবস্থার যে হাল, তাতে ফলাফল নির্ধারিত। শুধু শুধু শাসকদের নির্বাচনী বৈধতা দেওয়ার দরকার কী? তবে ভিন্ন কথা যাঁরা ভাবছেন, তাঁদের অভিমত, বেহাল সাংগঠনিক অবস্থায় কোনো না কোনা কর্মকাণ্ডে থাকা দরকার। আন্দোলন নেই, এটা গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও পরাহত। তাই নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে থাকলে নেতা-কর্মীরা অন্তত একটু চলাফেরার সুযোগ পান। তাঁরা ‘কাজের মধ্যে’ থাকতে পারেন। তাই নির্বাচনে যাওয়াটাই গ্রাহ্য।

এ বছর দুটো বড় নির্বাচন হলো। দুটোতেই অংশ নিয়েছে বিএনপি। এর একটি হলো চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচন। এ নির্বাচন হয় ১৩ জানুয়ারি। নির্বাচনের মাঝপথে বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান নির্বাচনে ভোট গ্রহণ স্থগিতের দাবি জানান। তিনি এ সময় অভিযোগ করেন, ১৭০টি কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় সব কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। ভোটারদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না। গোপন বুথে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা ভোট দিচ্ছেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেতেন।

১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দুই সিটির ভোট হয়। এ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করে এর ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। দুই সিটিতেও জেতে আওয়ামী লীগ। দুই সিটির ভোটে অংশ নেওয়ার আগে বিএনপির কোনো কোনো নেতা এ নির্বাচনকে একটি টেস্ট কেস হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। এ নির্বাচন খারাপ হলে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষে ছিলেন কেউ কেউ। দুই সিটির নির্বাচনের ‘তিক্ত’ অভিজ্ঞতার পর তাহলে বিএনপি আদৌ কি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে?

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আর কোনো ভোটে অংশ না নেওয়ার মত হয়তো কারও ছিল। দলে নানা মত থাকতেই পারে, তবে এটাই মূল ভাবনা, তা ভাবার কোনো অবকাশ নেই।’

চট্টগ্রামের নেতা আমীর খসরুর কাছে প্রশ্ন ছিল, তাঁর দল সিটি নির্বাচনে আসছে কি না। বিষয়টি তিনি স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেন। আমীর খসরু বলেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় রাখার জন্য নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। দলের একটি শক্তিশালী অংশ মনে করে, আমরা সরকারকে বৈধতা দিচ্ছি। তবে আসলে বৈধতা দিচ্ছি না। আমার মনে হয় সরকারকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে, নির্বাচনে অংশ না নিলে এই কথাটা বলতেও পারতাম না।’

বিএনপির নীতিনির্ধারণী কেন্দ্র স্থায়ী কমিটির এই সদস্যের মন্তব্য তাই ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনের মাঠ এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে না। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান যদিও মনে করেন, এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়া অর্থহীন। তবে তাঁর কথা হলো, ‘কখনো কখনো রাজনৈতিক কারণে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’

তাহলে চট্টগ্রাম সিটিতে কি সেই রাজনৈতিক কারণেই অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বিএনপি? নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে যা–ই সিদ্ধান্ত হোক, তা হবে কৌশলগত।’

বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবশ্য মনে করেন, আর কোনো নির্বাচনে বিএনপির যাওয়ার অর্থ হয় না।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘দুই সিটি ভোটে জনগণ জানিয়ে দিয়েছে, তারা ভোট দিতে ইচ্ছুক না। তারা মনেই করে, এটা প্রহসনের ভোট হয়। জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে, এটা প্রমাণিত। ভোটে গিয়ে বিএনপিকে আর সেটা প্রমাণের দরকার নেই।’

তবে বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল আরেক বুদ্ধিজীবী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সিদ্দিক আহমদ চৌধুরী মত হলো, এত কিছুর পরও নির্বাচন ও আন্দোলন—দুটোতেই বিএনপির থাকা দরকার। মতের সপক্ষ তাঁর যুক্তি হলো, সেই অর্থে বিএনপি কোনো কার্যকর আন্দোলনে নেই। মাঠে প্রচুর সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপি রাস্তায় দাঁড়াতে পারছে না, আন্দোলনে থাকতে পারছে না। তাহলে নির্বাচনই আসল বিকল্প।

অধ্যাপক সিদ্দিক আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘আমার ধারণা, বিএনপি চট্টগ্রাম সিটির ভোটে আসবে। না এলে লাভ কী হবে? ভোটের ফল কী হবে, সেটা সবাই জানে। আন্দোলন করতে পারছেন না, এখন নির্বাচন না করলে কর্মীদের প্ল্যাটফর্ম কোথায়, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তারা? ড্রয়িংরুমে বসে “নির্বাচনে যাওয়ার দরকার নাই” বলা সহজ।’

ড্রয়িংরুমে নয়, যাঁরা মাঠে থাকেন, চট্টগ্রামের সেই নেতা-কর্মীরা কিন্তু কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে। নগর বিএনপির সভাপতি ও সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী শাহাদত হোসেন বলেন, ‘সিদ্ধান্তের জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করছি। কিন্তু বর্তমান ধারায় নির্বাচন হলে আমি আগ্রহী নই।’

আপাত–‘অনাগ্রহী’ শাহাদাত হোসেন অবশ্য জানান, কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁকে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।

ঢাকার দুই সিটির ভোটের পরও কেন্দ্র থেকে বার্তা আসছে কি না? প্রশ্নের জবাবে শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘তাঁরা তো নির্বাচনী ট্রাকের মধ্যে আছেন। নির্বাচনী পরিবেশটা যদি সরকার তৈরি করে, তখন আমাদের বা সাধারণ মানুষ সবারই ইচ্ছা হবে ভোটে আসার। দেখা যাক কী হয়।’

চট্টগ্রামে ২০১০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সিটির মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে লক্ষাধিক ভোটে হারিয়ে জয়ী হন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মঞ্জুরুল আলম। ওই নির্বাচন বিরোধী দল বিএনপিকে উদ্দীপ্ত করে। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ী হন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাছির। তবে ওই নির্বাচনের মাঝপথে সরে আসেন বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থী মঞ্জুরুল আলম। সর্বশেষ চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচন ও ঢাকার দুই সিটি ভোটে মাঝপথে সরে যায়নি বিএনপি।

সিটির নির্বাচনেও ভোটের মাঠে সরে না যাওয়ার পক্ষে সিটি বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবু সুফিয়ান। তাঁর কথা, ‘হাইকমান্ড যদি সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন করবে তবে করব, তাহলে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।’

সব ভোটের ফল প্রত্যাখ্যানের পরও নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির এই নেতার যুক্তি হলো একটি নির্বাচনের মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ, যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা থাকে, তাঁরা একটু মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারেন। সুফিয়ান বলেন, ‘ভোটার হিসেবে বলি, নির্বাচনে যাওয়ার দরকার নেই। কেননা, ফল নির্ধারিত থাকে। তবে বিএনপির একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বলব, দরকার আছে।’

চট্টগ্রাম সিটি বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসেম বলেন, ‘সাংগঠনিকভাবে চট্টগ্রামে বিএনপি শক্তিশালী। নির্বাচনী প্রস্তুতি তো আমাদের সব সময় আছে। তবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই মূল।’

নির্বাচনে যাওয়ার কিছু যুক্তি তুলে ধরেন শাহাদাত হোসেন। তাঁর কথা, গত একাদশ সংসদ নির্বাচন, এরপরের একাধিক নির্বাচনে সরকারের জোরজবরদস্তির বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। জনগণের সামনে উঠে আসছে, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে না গেলে তো আপনারা জানতেও পারতেন না—এমন অবস্থা হবে। আর বিএনপি তো সশস্ত্র কোনো গোপন সংগঠন না। তাদের নির্বাচনের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। যে ধারায় নির্বাচন চলছে, এর অবসানও একদিন হবে।’