পোড়াদহের মেলায় দেড় লাখ টাকার বাঘাড় নিয়ে শোরগোল

ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় উঠেছে ৭২ কেজি ওজনের বাঘাড় মাছ। ছবি: সোয়েল রানা
ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় উঠেছে ৭২ কেজি ওজনের বাঘাড় মাছ। ছবি: সোয়েল রানা

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সরগরম ইছামতীর পাড়। সেখানে বসেছে ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা। সাতসকালে মেলায় ঢল নেমেছে লাখো মানুষের। নদ-নদী, পুকুর-দিঘি, খাল-বিলের বড় বড় মাছে চার শতাধিক দোকানে সারি সারি সাজানো কয়েক হাজার মাছ। সকাল থেকেই দোকানে দোকানে জমে উঠেছে হরেক মাছের কেনাবেচা। দোকানে দোকানে থরে থরে সাজানো রুই, কাতলা, চিতল, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্লাস কার্প, বোয়াল, ইলিশসহ হরেক পদের মাছ। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক, দর-কষাকষি ও হুড়োহুড়িতে সরগরম বিশাল মেলাপ্রাঙ্গণ।

প্রতিবছরের মাঘ মাসের শেষ বুধবার ইছামতী নদীতীরে বসে পোড়াদহ মেলা। মেলায় হাজার হাজার মণ মাছ কেনাবেচা হয়। মেলায় সাধারণত যা থাকে নাগরদোলা, চড়কি, খেলনা, মিঠাইয়ের সম্ভার—কোনো কিছুরই অভাব নেই। দূরদূরান্ত থেকে মেলায় শৌখিন মাছ কিনতে ভিড় করেন ক্রেতারা। মেলা উপলক্ষে জমে উঠেছে জামাই উৎসব। ঘরে ঘরে মেয়েজামাই, আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মেলায় মাছ-মিষ্টি ছাড়াও ছাড়াও বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলা, চড়কি, মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল খেলাসহ নানা আয়োজন। ছিল শিশুদের জন্য মৃৎশিল্প ও কাঠের খেলনা, বাঁশি, টমটম, কাঠ ও মাটির খেলনা, ঝুড়ি, খগরাই, বাতাসা, জিলাপি, চটপটি, ফুচকা, মৌসুমি ফল, চাটনি, আঁচার, কাচের চুড়ি, আলতা-ফিতা,লিপস্টিক-নেইলপলিশ, প্রসাধনীসহ নানা পণ্যের দোকান।

আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনকার শীর্ণ ইছামতী নদী অনেক বড় ছিল আগে। বছরজুড়ে নদীতে পানি থইথই করত। চলত পালতোলা নৌকা। নৌকায় চড়ে বাণিজ্যে আসতেন বণিক ও সওদাগরেরা।

গোলাবাড়ি বাজার বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামিম হাসান বলেন, ইছামতীর তীরে বটতলায় প্রথম পোড়াদহ মেলা বসে। একসময় এই মেলা থেকে শখের মাছ কিনে ইছামতী নদীতে সওদাগরি নৌকা ভাসিয়ে ঘরে ফিরতেন বাণিজ্য করতে আসা সওদাগরেরা।

আজ বুধবার সরেজমিন মেলায় দেখা গেছে, পছন্দের বড় মাছ কিনছেন ক্রেতারা। একটি দোকানে বিশাল বড় আট–দশটি বাগাড় মাছ সাজিয়ে বসেছেন মাছ ব্যবসায়ী বিপ্লব প্রামাণিক। যমুনা নদীতে ধরা পড়া ৭২ কেজি ওজনের একটি বিশাল আকৃতির বাগাড়ের দাম দোকানি হাঁকলেন দেড় লাখ টাকা। সালাহউদ্দিন নামের এক ক্রেতা দাম করলেন ৮৭ হাজার টাকা। দোকানি এবার ১ লাখ ৩১ হাজার টাকায় নামলেন। ক্রেতা হাঁকলেন ৯০ হাজার টাকা।

এবারের মেলায় আকর্ষণ বিপ্লব প্রামাণিকের এই ৭২ কেজি ওজনের বাগাড় এবং ১৮ কেজি ওজনের মাছের আদলে তৈরি বালিশ মিষ্টি। বড় এই বাগাড় ছাড়াও বিপ্লব প্রামাণিক যমুনায় ধরা পড়া ৩৮ কেজি ওজনের জ্যান্ত একটি বাগাড় মাছের দাম হাঁকছিলেন ৬০ হাজার টাকা।

২০ কেজি ওজনের একটি কাতল মাছ দরদাম করছিলেন ক্রেতা শফিকুল ইসলাম। বিক্রেতা দুলাল মাছটির দাম হাঁকেন ২৪ হাজার টাকা। মুনসুর রহমান নামের আরেক ক্রেতা তা ২০ হাজার টাকায় তা কিনে নেন।
মাছ বিক্রেতা ইসরাইল হোসেন বলেন, এ মেলায় একসময় যমুনা, করতোয়া, ইছামতী, বাঙ্গালী নদীতে ধরা পড়া মাছ বেশি মিলত। এখন খাল-বিল, পুকুর-দিঘির চাষের মাছের আমদানি বেশি।
মেলা ঘুরে দেখা গেছে, এখানে বড় কাতল মাছ গড়ে প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০, রুই ১০০০, বিগহেড ৭০০, গ্রাস কার্প ৭০০ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, মেলায় চার শতাধিক দোকানে এবার ২০ কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়েছে। অন্যবারের চেয়ে এবার মাছের আমদানি ও দাম দুটোই বেশি।
মেলায় বড় মাছ ছাড়াও মাছের আদলে তৈরি ১৮ কেজি ওজনের ‘মাছ মিষ্টি’র দাম হাঁকা হয়েছে ৯ হাজার টাকা।

ঐতিহ্যবাহী এই পোড়াদহ মেলাকে ঘিরে গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়ন ছাড়াও গাবতলী সদর, দুর্গাহাটা, বালিয়াদীঘি এবং নশিপুর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে ঘরে ঘরে জমে উঠেছে জামাই উৎসব। মেয়েরা বাবার বাড়ি নাইওর এসেছেন। শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে মেলা থেকে মাছ কিনে হাজির হয়েছেন জামাইরা। আজ বুধবার পোড়াদহ মাছের মেলা শেষ হলো। কাল বৃহস্পতিবার সকালে একই স্থানে বসবে শুধু নারীদের জন্য ‘বউমেলা’।