বসন্ত উৎসবের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা সংগ্রাম চত্বরে উদ্‌যাপিত হয় ‘ভালোবাসার মাতৃভাষা উৎসব ২০২০’। ঢাকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা সংগ্রাম চত্বরে উদ্‌যাপিত হয় ‘ভালোবাসার মাতৃভাষা উৎসব ২০২০’। ঢাকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতাসংগ্রাম চত্বরে ‘ভালোবাসার মাতৃভাষা উৎসব ২০২০’ আয়োজন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রভিত্তিক (টিএসসি) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। এই উৎসব ঘিরে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের দুটি পক্ষের নেতা-কর্মীরা।

শুক্রবার ভালোবাসা দিবস ও বসন্তের প্রথম দিন উপলক্ষে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলছেন, এই আয়োজনের কোনো লিখিত অনুমতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেয়নি। এর আগে গত বছরের এপ্রিলে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান কোমল পানীয় মোজোর দেওয়া অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে পয়লা বৈশাখের উৎসব পণ্ড হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভালোবাসার মাতৃভাষা উৎসবের আয়োজন ঘিরে বৃহস্পতিবার রাতে টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে মঞ্চ সাজানোর কাজ চলছিল। ওই চত্বরে ছাত্রলীগের নেতারা নিয়মিত ব্যাডমিন্টন খেলে থাকেন। প্রতিদিনের মতো ব্যাডমিন্টন খেলা শেষ করার পর রাত একটার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর ছাত্র পরিবহন সম্পাদক শামস-ঈ-নোমান, সাংগঠনিক সম্পাদক সম্পাদক বরিকুল ইসলাম, নাজমুল সিদ্দিকী, শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মাসুদ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখার সাধারণ সম্পাদক আল আমিন রহমানসহ কয়েকজন নেতা তখন চত্বরে থাকা আয়োজক ও শ্রমিকদের কাছে গিয়ে জানতে চান, তাঁরা এই অনুষ্ঠানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছেন কি না। তাঁরা এও জানতে চান, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে এই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জানানো হয়েছে কি না। দুই পক্ষের বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে এমন পরিস্থিতিতে মঞ্চ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা শ্রমিকেরা ভয় পেয়ে কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলার প্রস্তুতি নেন। শুক্রবার সকালেও ছাত্রলীগের ওই নেতারা অনুষ্ঠান আয়োজনে বাধা দিতে যান। তবে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান হয়েছে।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করে বলেন, এই প্রোগ্রাম ঘিরে বড় ধরনের অর্থের লেনদেন হয়েছে। টাকার অঙ্কটি তাঁরা বিভিন্ন মাধ্যমে ৫৩ লাখ, ৫০ লাখ ও ৩৭ লাখ টাকা বলে শুনেছেন। ছাত্রলীগের অন্য কোনো নেতাকে এই টাকার ভাগ দেওয়া হয়নি, এমনকি জানানোও হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেনের একক তৎপরতায় অনুষ্ঠানটি হচ্ছে অভিযোগ করে তাঁরা বলেন, ক্যাম্পাসে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো অনুষ্ঠান তাঁরা চান না।

অভিযোগের বিষয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য সানোয়ারুল হক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, অনৈতিক অর্থ লেনদেনের যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে যখন মঞ্চ সাজানোর কাজ চলছিল, তখন ছাত্রলীগ নেতা শামস-ঈ-নোমান, বরিকুল ইসলাম, নাজমুল সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আল মাসুদ ও আল আমিন রহমানসহ কয়েকজন সেখানে আসেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে আবদুল্লাহ আল মাসুদ আমাদের বলেন, “ছেলেপেলেদের খুশি করে দাও। এই আয়োজনের টাকার ভাগ পাওয়া পলিটিক্যালদের হক।’’ কিন্তু  আয়োজনের পৃষ্ঠপোষক বাংলালিংকের এজেন্সি থেকে আমাদের নগদ মাত্র এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানের খরচ তারা নিজস্ব ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে করে থাকে, নগদ কোনো টাকা দেয় না। ফলে এখানে আর্থিক লেনদেনের প্রশ্নই ওঠে না। অভিযোগটি পুরোপুরি অবান্তর।’

ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদের দাবি, বৃহস্পতিবার থেকে তিনি ক্যাম্পাসেই নেই। যদিও ঘটনস্থলে থাকা একাধিক নেতা মাসুদের ঘটনাস্থলে থাকার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। আয়োজনের আহ্বায়ক সানোয়ারুল হক বলছেন, তাঁদের কাছ থেকে অর্থ দাবির অপরাধ হালাল করার জন্য ছাত্রলীগের ওই পক্ষটি ‘ব্লেইম-গেম’ খেলছে।

ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতা শামস-ঈ-নোমান দাবি করেন, অর্থ ভাগাভাগির ঘটনার সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই৷ তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে৷

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা বরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসের যেকোনো অনুষ্ঠানে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু বসন্ত উপলক্ষে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠান সম্পর্কে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের জানানোই হয়নি বলে শুনেছি। যেহেতু গত বছর পয়লা বৈশাখের আয়োজন ঘিরে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছিল, সেই আশঙ্কা থেকেই আমরা আয়োজকদের কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম যে প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না। অনুষ্ঠানটি কারা করছে, কেন করছে, আমরা কিছুই জানতাম না। আমরা শুনেছি, এই অনুষ্ঠান ঘিরে ৩৭ লাখ, ৫০ লাখ কিংবা ৫৭ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে।’

পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান বাংলালিংকের পক্ষে অনুষ্ঠানটির ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা স্কাই ট্রাকারের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আয়োজনটির জন্য কিছু টাকা আয়োজকদের নগদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ তবে টাকার অঙ্ক ও অনুষ্ঠানটিতে মোট বরাদ্দ কত ছিল, তা বলতে অস্বীকৃতি জানান ওই কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, তাঁরা এই বিষয়ে কিছুই জানেন না।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ডের দায়দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেবে না। আমরা এই অনুষ্ঠান করার লিখিত কোনো অনুমতি দিইনি। অনুমতি ছাড়া যাঁরা এই অনুষ্ঠানটি করেছেন, তাঁরা প্রতারণা করেছেন। করপোরেট বডিগুলোকে সাবধান করতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সম্মতি ছাড়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে টাকা তুলে দেওয়া ঠিক নয়।’