সংখ্যায় এগিয়ে কবিতা, বিক্রিতে উপন্যাস
তখন দুপুর। ফাঁকা ফাঁকা বইমেলা। হুইলচেয়ারে বসে সত্তর পার করা এক বৃদ্ধা। যিনি ঠেলছেন চেয়ার, তাঁর বয়সও সত্তরের কাছাকাছি হবে। দুজনের হাতেই বইয়ের প্যাকেট। মুখে তৃপ্তির হাসি।
মন ভালো করা এই দৃশ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। বইমেলাই পারে সত্তর বসন্ত পেরিয়ে আসা পাঠকদের সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে ঘর থেকে বের করে আনতে। আনতে পারে মা–বাবার হাত ধরে আসা অগণিত নবীন পাঠকদের মিষ্টি হাসি।
আগের দিনের জনস্রোতের পর গতকাল প্রকাশক ও পাঠক—উভয়েই মন ভালো করা দিন পার করলেন। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা—রাত যতই এগিয়েছে, ভিড়ের বহর ততই বেড়েছে। তরুণ–তরুণীরা গতকালও বসন্ত উদ্যাপন করেছেন, হয়েছে ভালোবাসার বই বিনিময়। বিক্রিও হয়েছে যথেষ্ট।
অনেকেই বলছেন, এবার বইমেলা নিকট অতীতের মধ্যে সুন্দরতম মেলা। অবশ্য এ নিয়ে খুব বেশি গবেষণারও প্রয়োজন নেই। সাড়ে আট লাখ বর্গফুট জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে মেলা। স্টল এবং প্যাভিলিয়নের বিন্যাসও হয়েছে স্বচ্ছন্দে ঘোরাঘুরির মতো।
শুধু বিন্যাস নয়, প্রকাশকেরাও যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন মূল স্রোতের সঙ্গে তাল মেলাতে। দূর থেকে যেমন নজর কাড়ে প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের প্যাভিলিয়নটি, তেমনি পাঠক সমাবেশের ভেতরে গেলে পাঠক একটু দম ফেলতে পারছেন। প্যাভিলিয়নটির ভেতরে রাখা সোফায় বসে বইও পড়ছেন কেউ কেউ। প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নটি ছিমছাম সুন্দর। অন্যপ্রকাশ এবারও যথারীতি প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছে হুমায়ূন আহমেদের ছবি দিয়ে। ছোটদের বইয়ের বিশাল সম্ভার রয়েছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সে। আর সে জন্যই প্যাভিলিয়নটি সাজানো হয়েছে শিশুদের মনের মতো করে।
১৪ দিনে ২ হাজার ১৯৪ নতুন বই
মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির তথ্যানুযায়ী, মেলায় বিগত ১৪ দিনে নতুন বই এসেছে ২ হাজার ১৯৪টি। সংখ্যার বিবেচনায় এগিয়ে আছে কবিতার বই, মোট ৬৩৭টি। এরপরেই উপন্যাস, ৩৬৭টি। গল্পের বই রয়েছে ২৯৫টি। প্রবন্ধ ১২৩, গবেষণা ৪৩, শিশুতোষ ৯১, ছড়া ৪৬, বঙ্গবন্ধু ৭১, অনুবাদ ২৩, সায়েন্স ফিকশন ৪১ ইত্যাদি।
গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ২০৩টি। প্রথমা প্রকাশন এনেছে আবুল বাসার অনূদিত মিচিও কাকুর ফিজিকস অব দ্য ইমপসিবল। বেঙ্গল পাবলিকেশনস এনেছে সমাজ রাষ্ট্র বিবর্তন: জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক গুণিজন বক্তৃতামালা (২০১৭-২০১৮)। বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে প্রাবন্ধিক মফিদুল হকের ব্যক্তিত্ব ও বাঙালি সমাজ। বৈভব এনেছে মাহবুব মোর্শেদের অরব বসন্ত। শিখা প্রকাশনী এনেছে রুখসাৎ তানজীমের নৈঃশব্দ্যচরণ। বেহুলাবাংলা প্রকাশনী এনেছে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী দম্পতি গুলশান আরা কাজী ও কাজী বেলাল শাহজাহানের প্রবন্ধের বই জলছবি। আগামী প্রকাশনী এনেছে আবুল কাসেম ফজলুল হক সম্পাদিত সাহিত্য জিজ্ঞাসা সাহিত্যসৃষ্টি ও সাহিত্যবিচার। বাংলাপ্রকাশ এনেছে শামসুজ্জামান খানের আধুনিক ফোকলোর চিন্তা। অনিন্দ্য এনেছে মোশতাক আহমেদের জোছনার ছায়া। চন্দ্রবিন্দু এনেছে রাসেল রায়হানের অমরাবতী। অন্যপ্রকাশ এনেছে হাসনাত আবদুল হাইয়ের কলকাতা রানাঘাট, হক ফারুক আহমেদের কাব্যগ্রন্থ মেঘ দরিয়ার মাঝি।
শিশুদের কলকাকলিতে মুখর সকাল
ছুটির দিন শিশুপ্রহর ছিল। শিশুরা মা–বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে। নতুন বই নিয়ে বাড়ি ফিরেছে অনেকেই। সকালে মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন শিল্পী কল্যাণী ঘোষ, ইয়াকুব আলী খান ও চন্দনা মজুমদার। ২২ ফেব্রুয়ারি বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়া হবে।
বিকেলে মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে শাহ্জাহান কিবরিয়ার লেখা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শীর্ষক বইয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আনজীর লিটন। অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন হরিশংকর জলদাস ও খালিদ মারুফ।
কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি মারুফুল ইসলাম, আমিনুর রহমান, শামীম রেজা ও মাসুদ পথিক। আবৃত্তি করেন আবৃত্তিশিল্পী কাজী মাহতাব সুমন, মো. সামসুজ্জামান ও শামীমা নাসরিন। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেয় গোলাম মোস্তফা খানের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’, মানজারুল ইসলামের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী’ ও বিশ্বজিৎ রায়ের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘নিবেদন’।