চীনফেরত ৩১২ জন এবার ১০ দিনের বিশেষ পর্যবেক্ষণে

আশকোনা হজ ক্যাম্পে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা চীনফেরত ৩১২ জনকে শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আগামী ১০ দিন তাঁরা বিশেষ পর্যবেক্ষণে থাকবেন। এ সময় তাঁদের কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কোয়ারেন্টাইনে থাকা চীন থেকে আগত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই শর্ত দেওয়া হচ্ছে না।

এদিকে চীনের হুবেই প্রদেশে থাকা আরও ১৭১ জন বাংলাদেশিকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে শুভেচ্ছাস্মারক হিসেবে চীনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, গাউন ও হাতমোজা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তির ৫০০ স্বাস্থ্য পরীক্ষার উপকরণ দিচ্ছে চীন।

গত ডিসেম্বরে চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণে কোভিড রোগে গত ৩৮ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ৬০০ ছাড়িয়েছে। চীনের বাইরে ২৮টি দেশ ও অঞ্চলে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসটির সংক্রমণে গতকাল তাইওয়ানে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ফিলিপাইন, হংকং, জাপান ও ফ্রান্সে চারজন মারা গেছে। এর মধ্যে তিনজন চীনের নাগরিক। বাংলাদেশে এখনো কারও মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়নি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ সন্দেহে গতকাল একজন চীনা নাগরিককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

শর্ত সবার জন্য নয়
চীনের উহানফেরত ৩১২ জন বাংলাদেশিকে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আশকোনা হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়। তাঁদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন শেষে গত শনিবার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এই ১৪ দিন স্বজনেরা তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি।

গতকাল রোববার নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ৩১২ জনকে ‘শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দেওয়া’ (কন্ডিশনাল রিলিজ) হয়েছে। আগামী ১০ দিন তাঁদের কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে। তাঁরা তা মানছেন কি না, সে ব্যাপারেও খোঁজ রাখবেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজন।

মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ৩১২ জনের সবাই সুস্থ। তা হলে আরও ১০ দিন বিশেষ সতর্ক অবস্থায় থাকার প্রয়োজন হলো কেন—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধি হচ্ছে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা। আমরা তা রেখেছি। কিন্তু অন্তত একটি গবেষণাপত্রে আরও ১০ দিনের কথা বলা হয়েছে। তাই অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমরা এই ১০ দিনের পরামর্শ দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রেও চীনফেরত ব্যক্তিদের ১৪ দিন পর শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ১০ দিন বিশেষ বিধি মানতে বলা হচ্ছে।

অবশ্য এমন শর্ত কোয়ারেন্টাইনে থাকা অন্যদের ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ২০ জন চীনা শ্রমিক কোয়ারেন্টাইন শেষে গত শনিবার কাজে যোগ দিয়েছেন। কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা চিন্ময় হালদার প্রথম আলোকে বলেন, চীন থেকে আসা ২০ জন শ্রমিককে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল। এই ১৪ দিনে কারও ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ দেখা যায়নি। তাঁরা সুস্থ। তাই তাঁরা কাজে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশের আরও বেশ কয়েকটি জায়গায় বা প্রকল্পে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা চলছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল, বড়পুকুরিয়া, কুমিল্লা ইপিজেড, পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনা শ্রমিক ও কর্মচারীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে।

শর্তসাপেক্ষে অন্যদের ছেড়ে না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, চীনের কোন এলাকা থেকে বাংলাদেশি বা চীনারা আসছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশিরা সবাই এসেছিলেন চীনের উহান থেকে। উহান সংক্রমণের উৎপত্তি স্থান এবং বেশি মানুষ আক্রান্ত।

যেসব শর্তে ৩১২ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা বদল করা যাবে না; জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে এবং নিয়মিত সাবান ও পানিতে দুই হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি অসুস্থতা (জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট) দেখা দিলে আইইডিসিআরে ফোন করতে হবে, নির্দিষ্ট একজন রোগীর সেবা করবেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আশকোনায় কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাংলাদেশিদের কন্ডিশনাল রিলিজ দেওয়া হয়েছে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্যই তা করা হয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তা–ই হওয়া উচিত। তা না হলে নানা প্রশ্ন উঠবে।

সন্দেহজনক দুজন
একজন চীনা নারীকে গতকাল দুপুরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে হাসপাতালের পরিচালক ফরিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। ওই নারীর জ্বর ও সর্দি ছিল। ৪ ফেব্রুয়ারি ওই চীনা নাগরিক চীন থেকে বাংলাদেশে আসেন। তিনি উত্তরাঞ্চলের একটি ইপিজেডে কাজ করেন। ওই চীনা নাগরিকের রক্ত ও লালার নমুনা আইইডিসিআরে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে।

এর আগে চীরফেরত তিন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁদের কারও করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়নি।

সিঙ্গাপুরেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে। সে দেশে পাঁচজন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গুরুতর একজন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। এই সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরা একজনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় আনা হয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলার সিভিল সার্জন ও টাঙ্গাইল সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, বাসাইল উপজেলার এক ব্যক্তি সম্প্রতি সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরেছেন। এলাকাবাসী সন্দেহ করছেন তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে প্রথমে তাঁকে উপজেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর তাঁকে সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। করোনাভাইরাসের কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি। এরপরও তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য
চীনা নাগরিকদের বাংলাদেশে আসা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম প্রথম আলোর কলাপাড়া প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, খুব শিগগির ৫০ জন শ্রমিক চীন থেকে আসবেন। আসার আগে চীনে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হবে। এরপর বাংলাদেশে বিমানবন্দরে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হবে। এরপর তাঁদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। পরে তাঁদের কাজে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে।

করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে বাংলাদেশকে একেবারে আধুনিক প্রযুক্তির ৫০০ স্বাস্থ্য পরীক্ষার উপকরণ দিচ্ছে চীন। আগামী দুই দিনের মধ্যে ওই উপকরণ বাংলাদেশে পৌঁছাবে। ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে শুভেচ্ছাস্মারক হিসেবে চীনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, গাউন ও হাতমোজা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এদিন চীনের রাষ্ট্রদূতকে পাশে রেখে বলেন, ‘চীন সরকার খুব ভালোভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করছে। ভাইরাসটি যাতে ছড়াতে না পারে, এ জন্য দেশটি খুব শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার হার এখন কমতির দিকে। চীনে করোনাভাইরাসে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় এরই মধ্যে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই নয়, শেখ হাসিনা দলীয় পর্যায় থেকেও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধানকে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।’ তিনি জানান, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীনকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, গাউন ও হাতমোজা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ।

চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, ‘করোনাভাইরাস ইস্যুতে বাংলাদেশ যেভাবে পাশে থেকে চীনকে সহমর্মিতা দেখাচ্ছে এবং সহযোগিতা করে যাচ্ছে, তা বন্ধুত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। আমরা বাংলাদেশ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে সাময়িক ক্ষতি হতে পারে। এতে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে বড় কোনো সমস্যা সৃষ্টি হবে না বলে মনে করেন চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও মনে করেন, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দুই দেশের বাণিজ্যে তেমন কোনো সমস্যা হবে না।

চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সাময়িক সমস্যা হলেও আমদানি-রপ্তানিতে তেমন বড় কোনো ঝামেলা তৈরি হবে না। এরই মধ্যে নববর্ষের ছুটি শেষ হয়েছে, চীনের লোকজন কাজে ফিরতে শুরু করেছেন। সবকিছু সামাল দেওয়া যাবে।

রাষ্ট্রদূতের মতে, কাঁচামাল বিশেষ করে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এখনই বিকল্প বাজার খোঁজার সময় হয়নি। চীন এখনো আগের মতোই বাণিজ্য খাতে বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করতে পারবে।

বাকি ১৭১ জনকে আনা হবে
এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘হুবেই প্রদেশে থাকা আরও ১৭১ জন বাংলাদেশিকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে। তাঁদের মধ্যে ৩০ জন নিজেদের অর্থে দেশে ফিরতে রাজি আছেন বলে দূতাবাসে নাম নিবন্ধন করেছেন। তবে আমরা সবাইকেই ফিরিয়ে আনব। এ ব্যাপারে কাজ চলছে। সেখান থেকে লোকজনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার পুরো বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। ভাইরাসটি যেন ছড়াতে না পারে, এ জন্য কিছু করণীয় আছে। তাই কবে নাগাদ এই ১৭১ জন ফিরবেন, তার দিন-তারিখ এখনই বলা যাচ্ছে না।’ তিনি জানান, চীনে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে বাংলাদেশের দূতাবাস।