কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের সবখানে অব্যবস্থাপনা, পর্যটকেরা অস্বস্তিতে

কুয়াকাটা সৈকতে অবাধে চলে এসব যানবাহন।  ছবি: প্রথম আলো
কুয়াকাটা সৈকতে অবাধে চলে এসব যানবাহন। ছবি: প্রথম আলো

পর্যটন পুলিশের পক্ষ থেকে চলছে মাইকিং। ঘোষণা ভেসে আসছে, সৈকতে কোনো মোটরসাইকেল ও গাড়ি চালানো যাবে না। ঠিক তখনই সবার চোখের সামনে সৈকতে চলছে নানা ধরনের যানবাহন। এ ধরনের যত অব্যবস্থাপনা থাকতে পারে, তার সবই এখন আছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে। এসবে বিরক্ত হয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন পর্যটকেরা।

সৈকতে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা স্বীকার করে নিলেন কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশের পরিদর্শক মো. সরোয়ার হোসাইন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কুয়াকাটায় মানুষের এত চাপ বেড়েছে যে তা সামলানো মুশকিল। জনবলের অভাবে সবকিছু দেখভাল করা সম্ভব হয় না। তারপরও আমরা বসে নেই। চেষ্টা করে যাচ্ছি সবকিছু ঠিক রাখতে। মোটরসাইকেল বা যেকোনো ধরনের যানবাহন যাতে সৈকতে চলতে না পারে, সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সাগরকন্যা বলা হয় কুয়াকাটাকে। এখানে সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অনন্য সুযোগ রয়েছে। এ কারণেই সব সময় পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে থাকে কুয়াকাটা। তবে নয়নাভিরাম এই সৈকতে চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করায় তাঁদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, সৈকতের প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত চটপটি, মুড়ি-চানাচুরের দোকানপাট বসানো হয়েছে। সৈকতের পশ্চিম পাশে রয়েছে মাছ ভেজে বিক্রি করার রেস্তোরাঁ। এসব দোকানের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সৈকতেই। সৈকতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলাচল করছে মোটরসাইকেল, পিকআপ, চান্দের গাড়ি।

 উপরন্তু সৈকতে রয়েছে আলোকচিত্রীদের উৎপাত। সৈকতে পর্যটক দেখলেই পিছু নেন এসব আলোকচিত্রী। তাঁরা টাকার বিনিময়ে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য পর্যটকদের বিরক্ত করেন। এতে পর্যটকেরা যে একটু শান্ত পরিবেশে সাগরে নেমে গোসল করবেন, তার কোনো উপায় থাকে না।

ঢাকার সাভারের বাসিন্দা মো. ওয়াজি উল্লাহ পরিবার নিয়ে কুয়াকাটায় বেড়াতে এসেছিলেন। জানালেন তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচল করায় একটু নিরাপদে কুয়াকাটা সৈকতে হাঁটা যায় না। সৈকত ধরে হাঁটতে গেলে মনে হয় এই বুঝি গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেল পেছন থেকে ধাক্কা দিল। এ ছাড়া রয়েছে আলোকচিত্রীদের উৎপাত। কুয়াকাটার সৌন্দর্য উপভোগ করার বদলে এখানে এসে চরম কষ্ট আর হতাশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছি।’

এখানেই বিড়ম্বনার শেষ নয়। কুয়াকাটা সৈকতে পৌঁছানোর আগের দুই কিলোমিটার সড়ক যেন দুর্ভোগের অপর নাম। এই সড়কের পুরো অংশ দখল করে দূরপাল্লার বাস ও অভ্যন্তরীণ রুটের বাস দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এতে পর্যটকেরা নির্বিঘ্নে সৈকতে আসা-যাওয়া করতে পারেন না। এ ছাড়া দালালদের তৎপরতার কারণে পর্যটকেরা তাঁদের পছন্দের হোটেলে উঠতে পারেন না। এই দালাল চক্রের সদস্যরা কুয়াকাটার আগের স্টেশন আলীপুর থেকে বাসে উঠে পড়ে। বাসে বসেই তারা পর্যটকদের নানাভাবে ফুসলাতে থাকে। কুয়াকাটায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা পর্যটকদের ব্যাগ, মালামাল টানাটানি শুরু করে। অনেকটা জোর করেই তাদের পছন্দের হোটেলে নিয়ে যায় পর্যটকদের। হোটেল থেকে বের হলেই শুরু হয় ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলচালকদের উৎপাত। তাঁরা পর্যটকদের নানা সুবিধার কথা বলে বিভিন্ন দর্শনীয় স্পটে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে জোর করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়।

সব মিলিয়ে সৈকতের সৌন্দর্য যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি পর্যটকদের সৈকতে চলাচল করতে সমস্যা হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে বিব্রত স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, ‘এসব অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে আমরা বিভিন্ন সময় বলেছি। কলাপাড়ার ইউএনও এসে কয়েক দিন ব্যবসায়ীদের বলেছেন। কিন্তু বাস্তবমুখী কোনো পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। আমরা মনে করি, কুয়াকাটার পর্যটনশিল্পের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’

কুয়াকাটা সৈকত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্নতার জন্য ১৩ সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। জেলা প্রশাসক এই কমিটির সভাপতি। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, সৈকতের অব্যবস্থাপনাগুলো দূর করতে এই কমিটিরই সবার আগে সক্রিয় হওয়া দরকার। তা না হলে পর্যটকেরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পর্যটকদের সমস্যা সমাধানে এবং প্রতারণা বন্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কুয়াকাটায় যাতে যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে রাখা না হয়, সে জন্য একটি বাসস্ট্যান্ড করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম চলছে। সৈকতের অব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কুয়াকাটা সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা দ্রুত আহ্বান করা হবে। ওই সভায় এসব বিষয় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।