দ্রুত করোনাভাইরাস শনাক্ত করা মূল কৌশল সরকারের

>
ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

চীনকে মাস্কসহ ছয় ধরনের উপকরণ দিয়েছে বাংলাদেশ। চীনও বাংলাদেশকে কোভিড শনাক্ত করার উপকরণ দিচ্ছে।

দ্রুত করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ এবং আক্রান্ত ‘কোভিড-১৯’ রোগীকে দ্রুত আলাদা করে নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের কৌশল নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কর্মকর্তারা মনে করছেন, দেশে রোগ ঢোকা প্রতিরোধ করা সম্ভব না–ও হতে পারে।

সরকার স্থল, বিমান ও সমুদ্রবন্দরে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করছে। রোগ শনাক্ত করার সক্ষমতা বাড়িয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সুনির্দিষ্ট দুটি হাসপাতাল ছাড়াও সব সরকারি হাসপাতাল আলাদা ইউনিট খুলেছে। কিন্তু কৌশল হিসেবে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে রোগীকে শনাক্তকরণ ও তাদের আলাদা করার ওপর। 

এদিকে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার চীনকে হাত মোজা, মাস্কসহ বাংলাদেশে উৎপাদিত ছয় ধরনের উপকরণ দিয়েছে বাংলাদেশ। চীনও বাংলাদেশকে কোভিড শনাক্ত করার কিটস বা উপকরণ দিচ্ছে। এগুলো আজ বুধবার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত পাঁচ বাংলাদেশির মধ্যে একজনের অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশন বলেছে, ওই ব্যক্তির ফুসফুসের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দিয়েছে।

চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার ১ ফেব্রুয়ারি ৩১২ জন বাংলাদেশিকে চীনের উহান থেকে ফেরত আনলেও বাকি ১৭১ জনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। গত পরশু জাতীয় প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে চীনের রাষ্ট্রদূত এদের ফেরত না আনার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগের ৩১২ জনকে ফেরত আনা উড়োজাহাজের পাইলট ও ক্রুদের কিছু দেশে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার চীনা নাগরিক আছেন। 

অন্যদিকে ২৩–২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ‘ইন্টারন্যাশনাল সলিডারিটি ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২০’ স্থগিত হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় চীনের ক্রীড়াবিদদের অংশগ্রহণ করার কথা ছিল।

সংসদেও করোনাভাইরাস নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের কী প্রস্তুতি, তা জনগণকে অবহিত করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক। গতকাল তিনি পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেন, চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে এখনো এই ভাইরাসে আক্রান্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু করোনাভাইরাস নিয়ে সারা দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। কোনো কারণে দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হলে কী উপায়ে মোকাবিলা করা হবে, সরকারের কী প্রস্তুতি, মানুষ জানে না। মানুষ বিভ্রান্তিতে আছে। তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়গুলো অবহিত করে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়ার দাবি জানান।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কৌশল
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা গতকাল বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে (বিএমআরসি) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের কৌশল সম্পর্কে সবাইকে অবগত করেন। তিনি বলেন, ‘একসঙ্গে অনেক নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা আইইডিসিআরের আছে।’

পরে আইইডিসিআরের পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্দরে স্ক্যানার আছে ঠিকই। কিন্তু আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির রোগের লক্ষণ প্রকাশ না পেলে স্ক্যানারে কিছু ধরা পড়বে না। আক্রান্ত ব্যক্তির দেশে ঢুকে পড়াও তাই প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।’

মীরজাদী সেব্রিনা আরও বলেন, জোর দিচ্ছি দ্রুত রোগী শনাক্তকরণের ওপর। স্বাস্থ্য কার্ড ও স্ক্যানারের মাধ্যমে শনাক্তকরণের চেষ্টা চলছে। সেখান থেকে বাছাই করা সন্দেহভাজনের রক্ত বা লালার নমুনাও পরীক্ষা করা হচ্ছে। এখনো কেউ শনাক্ত হয়নি। শনাক্ত হলেই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে বা বাংলাদেশ–কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।

আইইডিসিআর সূত্র জানিয়েছে, আইইডিসিআরের ল্যাবরেটরিতে দুই–তিন ঘণ্টায় করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষার ফল পাওয়া যাচ্ছে। আরও কম সময়ে অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ মিনিটে শনাক্ত করার প্রযুক্তিও শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটির কাছে আসবে। এ ব্যাপারে মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নেই, এমন কিট বা প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করব না।’

গতকাল সন্ধ্যায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আইইডিসিআর জানিয়েছে, তারা এ পর্যন্ত ৭৪ জনের (তিনজন চীনা নাগরিকসহ) রক্ত বা লালার নমুনা পরীক্ষা করেছে। কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত পাঁচ বাংলাদেশির পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। আশকোনার কোয়ারেন্টাইন থেকে ছাড়া পাওয়া ৩১২ জনও সুস্থ আছে। 

বিশিষ্ট ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আইইডিসিআর এখন পর্যন্ত যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা ঠিক আছে।’

চীনকে বন্ধুত্বের স্মারক
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে গতকাল চীনকে হাত মোজা ও মাস্কসহ বাংলাদেশে উৎপাদিত ছয় ধরনের উপকরণ দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের হাতে এসব সহায়তা উপকরণ তুলে দেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এ সময় অন্যান্যের মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন উপস্থিত ছিলেন। এসব উপকরণের মধ্যে ১০ লাখ হাতমোজা, পাঁচ লাখ ফেস মাস্ক, দেড় লাখ টুপি, এক লাখ হাত পরিষ্কারক (হ্যান্ড স্যানিটাইজার), ৫০ হাজার শু কভার ও ৮ হাজার গাউন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘চীন আমাদের খুব ভালো বন্ধু। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালো সম্পর্ক রয়েছে। করোনাভাইরাসের এই আক্রমণের সময় প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে চীনের রাষ্ট্রপতিকে লেখা বার্তায় সমবেদনা ও সহায়তার কথা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বাংলাদেশের এই সহায়তা চীনের রাষ্ট্রদূতের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, চীনকে দেওয়া এই সহায়তা উপকরণের সবগুলোই বাংলাদেশের উৎপাদিত।

চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, বাংলাদেশের এই সহায়তা বন্ধুত্বের প্রতীক। এ জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চীন কৃতজ্ঞ থাকবে।

চীনের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশকে করোনাভাইরাস শনাক্ত করার কিটস বা উপকরণ দেওয়া হচ্ছে। চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ৫০০ কিটস দেওয়া হচ্ছে, যা দিয়ে সহজে, দ্রুততম সময়ে ও সঠিকভাবে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা যাবে। কিটসগুলোর আজ ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

সংশোধনী: গতকাল প্রথম আলোয় ‘চীন–সিঙ্গাপুরফেরত মানেই আক্রান্ত নয়’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি চীনফেরত শিক্ষার্থী আশকোনা হজ ক্যাম্পে ছিলেন। সঠিক তথ্য হচ্ছে, তিনি হজ ক্যাম্পে ছিলেন না।