মামলা নিষ্পত্তিতে রেকর্ড

২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে নান্দাইলের ভাটিসাভার দক্ষিণপাড়া গ্রামে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে একটি মারামারির ঘটনা ঘটে। সে ঘটনায় মোহাম্মদ আলী, লাল মিয়া ও রায়হান নামের তিন ব্যক্তিকে কুপিয়ে জখম করা হলে নান্দাইল থানায় একটি মামলা হয়। আসামি ছিল ১৩ জন। একই বছরের এপ্রিলে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর ২০০৫ সালে অভিযোগ গঠন করা হয়।

এরপর থেকে আদালতে মামলা চলতে থাকে, বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের হাজিরা ও সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে মামলা চলতে থাকে, কিন্তু কোনোভাবে মামলাটির নিষ্পত্তি হচ্ছিল না। এভাবে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও মামলাটির কোনো সুরাহা হয়নি। মামলা চলাকালে আসামিপক্ষের চারজন মারা গেলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৯। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর সাতজন আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।

এ ধরনের আরও অনেক মামলা চলমান ছিল, যেগুলো কমপক্ষে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে ছিল। কিন্তু গত এক বছরেই এ রকম ১৮১টি মামলার রায় হয়েছে বলে জানা গেছে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সূত্রে। শুধু যে দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকা মামলার রায় হয়েছে তা নয়, ১২ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের দক্ষতায় সহস্রাধিক মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাজট এখন অনেকটাই কমে এসেছে।

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মারামারি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও মাদকসংক্রান্ত মামলা করা হয়। জানুয়ারি শেষে এই আদালতে ২৫ হাজার ৩৯১টি মামলা চলমান রয়েছে। জানুয়ারিতেও ২ হাজার ২৭৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণ হওয়ার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই এক যুগে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১ লাখ ৪০ হাজার ৯৮২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরেই ১৯ হাজার ৫৩৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, যা কোনো নির্দিষ্ট সালে সর্বাধিক মামলা নিষ্পত্তির নজির।

নিষ্পত্তির পেছনে সময় বেশি লাগার কারণ সম্পর্কে জানা যায়, মামলা করার পর তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে অভিযোগপত্র দায়ের করা হলে তার ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন করা হয়। তারপর সাক্ষ্য গ্রহণ এবং উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় দেওয়া হয়। এর মধ্যে সাক্ষী হাজিরে অনীহা, চিকিৎসক হাজির না হওয়া, সাক্ষী হাজিরের ক্ষেত্রে পুলিশের তৎপরতার অভাব, রাজনৈতিক প্রভাবসহ বিভিন্ন সমস্যার জন্য মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় বেশি লাগত। ফলে মামলাজটের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছিল।

তবে এখন সেই পুরোনো ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। অতীতে মামলার সাক্ষী হাজির না হওয়া এবং সাক্ষী হাজিরে পুলিশের আশাব্যঞ্জক সাড়া না পাওয়ায় মামলা দীর্ঘায়িত হতো বলে জানিয়েছেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. রেজাউল করিম। কিন্তু এখন সাক্ষী হাজিরের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

>২০০৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১ লাখ ৪০ হাজার ৯৮২টি মামলা নিষ্পত্তি।

২০১১ সালের পর থেকে গত বছর পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৪৪০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৯ সালেই ১০ হাজার ৮৮০ জন সাক্ষী হাজির ছিলেন। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে গত বছরের তুলনায় এ বছর আরও বেশি সাক্ষ্য গ্রহণ ও মামলা নিষ্পত্তির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। মামলার সংখ্যানুপাতে বিচারক নিয়োগ করা গেলে এবং কম্পিউটার, আসবাবসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধি করা গেলে বিচারকার্যে আরও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের সাজা দেওয়ার বিধান থাকলেও ৭ বছর ও ১০ বছর করে সাজা দেওয়ারও নজির দেখা গেছে। ২০০৩ সালে দুদক বাদী হয়ে আফতাব উদ্দিন মেমোরিয়াল জুনিয়র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহাব উদ্দীনের নামে ভালুকা থানায় সনদ জালিয়াতি করে অবৈধভাবে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করে। পাঁচজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৪৬৮, ৪৭১ এবং ৪২০ ধারায় মোট ১০ বছরের সাজা দেওয়া, যেগুলো একটির পর একটি কার্যকর হবে।

এ ছাড়া ২০১৩ সালে ভালুকার রওশনারা বেগমকে বেদম প্রহার করা হলে রফিকুল ইসলামের নামে ভালুকা মডেল থানায় মামলা হয়। ৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৯সি ও ৩৩এ ধারার বিধান অনুসারে এবং সরকারি গেজেটের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের কারণে তাঁকে সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নুরুল হক বলেন, মাসিক জুডিশিয়াল পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে বর্তমানে মামলা নিষ্পত্তিতে আলাদা গতি এসেছে। প্রতি মাসে অনুষ্ঠিত এই কনফারেন্সে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, আইনজীবী, চিকিৎসক, পুলিশ, কারা কর্তৃপক্ষ নিজেদের সমস্যার কথা বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ পায়। তবে আদালত ভবনের এজলাসগুলো পুনর্বিন্যাস করা গেলে মামলাজট আরও কমবে বলে মত দেন তিনি।