তদন্ত ফেলে রেখেছে পুলিশ

চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে বৃদ্ধ সাহেব উল্লাহ হারিয়েছেন তাঁর দুই যুবক ছেলেকে। পিতৃহীন দুই নাতিকে নিয়েই সন্তান হারানোর শোক ভুলে থাকার চেষ্টা করেন তিনি। গতকাল পুরান ঢাকায় তাঁর বাড়িতে।  ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে বৃদ্ধ সাহেব উল্লাহ হারিয়েছেন তাঁর দুই যুবক ছেলেকে। পিতৃহীন দুই নাতিকে নিয়েই সন্তান হারানোর শোক ভুলে থাকার চেষ্টা করেন তিনি। গতকাল পুরান ঢাকায় তাঁর বাড়িতে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

চুড়িহাট্টায় পুড়ে যাওয়া ওয়াহেদ ম্যানশনের কালো কাঠামোর সামনে প্রতিদিন এসে দাঁড়ান বৃদ্ধ সাহেব উল্লাহ। এক বছর ধরে নিয়ম করে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর চলে যান। এই ভবনেই আগুনে পুড়ে মারা গেছেন তাঁর দুই যুবক ছেলে। ভবনটি এখন পরিত্যক্ত, আগুনও নিভে গেছে। কিন্তু বৃদ্ধের মনের আগুন এখনো জ্বলছে।

সাহেব উল্লাহর ছেলের মতো সেই আগুনে তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী মোহাম্মদ আসিফ হারিয়েছিলেন বাবা মোহাম্মদ জুম্মনকে। তবে তিনি আর ওয়াহেদ ম্যানশনের দিকে মাড়ান না। আগুনের ঘটনায় তিনি যে মামলা করেছিলেন, তার তদন্ত ফেলে রেখেছে পুলিশ। কবে সেই মামলার তদন্ত শেষ হবে, তার কিছুই তিনি জানেন না। আসিফ এ নিয়ে এখন আর কোনো কথাও বলতে চান না। আসিফের মতো ক্ষুব্ধ চুড়িহাট্টায় স্বজন হারানো মানুষেরা। তাঁদের দাবি, তদন্ত করে দোষীদের বিচার করা হোক।

গত সোমবার কথা হয় সাহেব উল্লাহর সঙ্গে। বললেন, ওয়াহেদ ম্যানশনে তাঁর দুই ছেলে মাসুদ রানা ও মাহবুবুর রহমানের মোবাইল ফোনের দোকান ছিল। আগুনে তাঁরা কেউই বাঁচতে পারেননি। মাহবুবের স্ত্রী আফরোজা সে সময় ছিলেন সন্তানসম্ভবা। ছেলে মারা যাওয়ার ছয় মাস পর তাঁর নাতি হয়। নাতিকে কোলে নিয়ে সন্তানের জন্য চোখের পানি ফেলেন তিনি।

গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর চুড়িহাট্টা মোড়ের কাছে চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে লাগা আগুন আশপাশের কয়েকটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রায় ১৪ ঘণ্টা চেষ্টার পর সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। ঘটনাস্থল থেকে ৬৭ জনের মরদেহ মর্গে পাঠান উদ্ধারকর্মীরা। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০। 

এ ঘটনায় ‘অবহেলার কারণে সৃষ্ট অগ্নিসংযোগের ফলে মৃত্যু ঘটাসহ ক্ষতিসাধনের’ অভিযোগে চকবাজারের বাসিন্দা মোহাম্মদ আসিফ চকবাজার মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ ওই ভবনের বিভিন্ন তলায় দাহ্য পদার্থ রাখতেন। জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিকের গুদাম করার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে বাসা ভাড়া দেন তাঁরা। আসিফ এই মামলায় দুই সহোদর ছাড়াও অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনকে আসামি করেন।

 আগুনের ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি। দুই ভাই আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর পুলিশ তাঁদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। গত বছরের ১৬ এপ্রিল তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। গত বছরের ৮ আগস্ট তাঁরা হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। পরে সেই জামিনের মেয়াদ আরও এক বছরের জন্য বাড়ানো হয়।

বহুল আলোচিত এই মামলা তদন্ত করছেন চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবীর হোসেন। তাঁর আগে পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ মোরাদুল ইসলাম তদন্ত করেছিলেন।

জানতে চাইলে কবীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে কয়েকজনের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু তাঁদের নাম ও সঠিক ঠিকানা পাওয়া যায়নি। আর ঠিকানা না পাওয়ার কারণে তাঁদের খোঁজ মেলেনি। তিনি বলেন, শুধু নাম দিয়ে তো তদন্ত হয় না।

 তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে কবীর হোসেন বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে না আসায় তদন্তও শেষ করা সম্ভব হয়নি। 

 পোড়া মৃতদেহের ময়নাতদন্তে এমন কী তথ্য থাকবে, যার জন্য তদন্ত আটকে আছে—জানতে চাইলে কবীর হোসেন বলেন, তদন্তের জন্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন খুব জরুরি। সেটা না থাকলে তদন্ত শেষ হবে না।

ময়নাতদন্তে দেরির কারণ জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ৬৭টি মৃতদেহের তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। দু–এক দিনের মধ্যে সেটা থানায় পাঠানো হবে। তিনি বলেন, এসব মৃতদেহের ডিএনএ পরীক্ষা করার কারণে তদন্ত শেষ করতে সময় লাগছে।

ঘটনার পর প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও ঘটনাস্থলের আলামত দেখে তদন্তকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা মনে করছিলেন, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে। ওই তলায় সুগন্ধির ক্যান ও বাল্বের গুদাম ছিল। এই অভিযোগ ধামাচাপা দিতে এলাকার বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীরা এককাট্টা হয়ে দাবি করেন, যানজটে আটকা থাকা একটি পিকআপের ওপরে থাকা এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মামলার তদন্তকারী পুলিশও এখন সেই সুরে সুর মেলাচ্ছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে এই আগুনের উৎপত্তি। সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ওই ঘটনায় যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁদের দাবি ভিন্ন, তাঁরা চান বিপজ্জনক কারখানা ও গুদাম সরানো হোক।

ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুনে ছেলে ওয়াসিমকে হারিয়েছিলেন বাবা নাসির উদ্দিন। সোমবার এই ব্যবসায়ী পিতা বললেন, বিস্ফোরকের ওপরই পুরান ঢাকার মানুষ ঘুমাচ্ছে। যেকোনো সময় যে কেউ মরে যেতে পারে, কিন্তু স্বার্থের কথা ভেবে সবাই চুপ থাকছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যহন জ্বইল্যা পুইড়া মইরা যামুগা, তখন মাইনসের হুঁশ হুইব।’

https://youtu.be/DRbbXU7sTO8