'১০ লাখ টাকা নিয়ে আয়'

এক মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের ভিডিও। এতে দেখা যাচ্ছে, গেঞ্জি ও ফুলপ্যান্ট পরা এক যুবকের দুই হাত কোমরের পেছনে বাঁধা। পা দুটিও হাঁটুর নিচ থেকে বাঁধা। মুখ বাঁধা কালো কাপড়ে। মেঝেতে ফেলে লাঠি দিয়ে ওই যুবকের পায়ের গোড়ালিতে একের পর এক আঘাত করছে এক ব্যক্তি। আর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করছেন ওই যুবক। পাশ থেকে মোবাইল ফোন দিয়ে ভিডিও করছেন আরেকজন। দু-তিনবার আঘাতের পর ওই যুবককে বলা হচ্ছে, ‘১০ লাখ টাকা নিয়ে আয়।’ এরপর আবার লাঠির আঘাত। কিছু সময় পর ওই যুবকের মাথা পা দিয়ে চেপে ধরে আবারও লাঠির আঘাত। আবারও বলা হয়, ‘১০ লাখ টাকা নিয়ে আয়।’

ভুক্তভোগী যুবকের নাম রাসেল হাসান (২৮)। তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায়। অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তার ছেলে তিনি। রাসেল হাসানকে নির্যাতনের এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

রাসেলের অভিযোগ, তাঁর স্ত্রী মন্টি আক্তারের ভাই পাপ্পু মিয়া তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে এভাবে নির্যাতন করেছেন। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর তাঁকে নরসিংদী জেলা আদালতের সামনে ডেকে পাঠান মন্টির বড় ভাই পাপ্পু মিয়া (৩৩)। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সেখানে গেলে ডিবি পরিচয় দিয়ে কয়েক ব্যক্তি তাঁকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেন। এ বিষয়ে মামলা না করতেও হুমকি দেন। পরে এ বিষয়ে তিনি র‍্যাব-১১–এর সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর আগে রাসেলের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছেন স্ত্রী মন্টি।

রাসেলের ভাষ্য, ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পরিবারকে না জানিয়ে মন্টিকে বিয়ে করেন তিনি। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি সৌদি আরবে চাকরি নিয়ে চলে যান। বিদেশ গিয়ে বাবা আবদুল হককে বিয়ের কথা জানান রাসেল। পরে পুত্রবধূ মন্টিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান রাসেলের মা–বাবা। বাবার অনুরোধে গত এপ্রিলে দেশে ফেরেন রাসেল। এক মাস থাকার গত বছরের মে মাসে আবার সৌদি আরব চলে যান তিনি। সৌদি আরব যাওয়ার পর রাসেলকে তাঁর স্ত্রী মন্টি জানান, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু রাসেলের মা–বাবা জানান, মন্টি তাঁদের না জানিয়ে নরসিংদীতে তাঁর বাবার বাড়ি চলে গেছেন। যাওয়ার সময় গয়না, মোবাইল ফোন নিয়ে গেছেন। এ খবর পেয়ে রাসেল গত ১৩ সেপ্টেম্বর আবার দেশে আসেন। মন্টির বাড়িতে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর গর্ভপাত হয়েছে। এর চার দিন পর নরসিংদী সদর থানায় রাসেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন মন্টি আক্তার।

মামলার এজাহারে মন্টি নিজেকে রাসেলের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেননি। তাঁর অভিযোগ ছিল, রাসেল তাঁর আপত্তিকর ছবি ভিডিও করেছেন। ওই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করেছেন রাসেল। ওই ভিডিও থানায় জমা দেন মন্টি।

রাসেলের অভিযোগ, ওই মামলার পর নানাভাবে রাসেলকে হয়রানি করতে থাকে মন্টির পরিবার। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর তাঁকে পাপ্পু মিয়ার লোকজন তুলে নিয়ে যায়।

রাসেল আজ বৃহস্পতিবার ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ডিবি পরিচয় দিয়ে কয়েক ব্যক্তি মাইক্রোবাস নিয়ে নরসিংদী আদালতের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে মন্টির ভাই পাপ্পু দৌড়ে পালিয়ে যান। অন্যদিকে আমাকে থানায় নেওয়ার কথা বলে মাইক্রোবাসে ওঠানো হয়। ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে সিটের নিচে ফেলে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। তৃষ্ণায় আমি পানি চাইলে সেভেন আপ দেওয়া হয়। কিন্তু সেভেন আপ পানের পর আমি চেতনা হারিয়ে ফেলি।’

রাসেল বলেন, চেতনা ফেরার পর দেখেন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তিনি একটি কক্ষের মেঝেতে পড়ে আছেন। এর কিছুক্ষণ পরই রাসেলকে পেটানো শুরু করেন পাপ্পু। পরে পাপ্পুর বন্ধু অভিকও মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে মারধরের ভিডিও ধারণ করে রাসেলের পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। ওই ভিডিও দেখে দেড় লাখ টাকায় সমঝোতা হয়। ২৮ ডিসেম্বর রাতে বিকাশে ৬০ হাজার টাকা পাঠায় রাসেলের পরিবার। বাকি ৯০ হাজার টাকা নগদ পরিশোধের কথা হয়। এই টাকা নিতে ২৯ ডিসেম্বর রাতে রাসেলকে মাইক্রোবাসে তুলে পাপ্পু ও তাঁর দলের লোকজন। রাত সাড়ে তিনটার দিকে মাইক্রোবাসটি নরসিংদী শাপলা চত্বরে আসার পর অপহরণকারীরা প্রস্রাব করতে নামেন। রাসেলও প্রস্রাবের কথা বললে তাঁকেও নামানো হয়। একটি পিকআপ ভ্যান সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় রাসেল চিৎকার শুরু করেন। তখন অপহরণকারীরা তাঁকে রেখেই দ্রুত পালিয়ে যান। এরপর রাসেল সারা রাত নরসিংদী রেলস্টেশনে কাটান। পরদিন সকালে কুমিল্লায় বড় বোনের কাছে চলে যান। সেখানে মুক্তি ক্লিনিকে চিকিৎসা করান।

রাসেলের ভাষ্য, চলতি বছরের ১১ ও ২৮ জানুয়ারি দুবার মামলা করতে নরসিংদী সদর থানায় যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু থানায় পৌঁছার আগেই মুঠোফোনে হুমকি দেন পাপ্পু। রাসেল বলেন, ‘আমাকে ২৮ ডিসেম্বর রাতে মারধরের পর অস্ত্র ও মাদক তুলে দিয়ে ছবি তোলেন পাপ্পু। তাই ভয়ে আর থানায় যাইনি। এরপর গতকাল বুধবার ১৯ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে র‍্যাব-১১–এর সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করি।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে নরসিংদীর বানিয়াছল মালিপাড়া এলাকায় মন্টি আক্তারের বাবা বাদল মিয়ার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তাঁর তিন মেয়ে, দুই ছেলে। এর মধ্যে ছোট ছেলে কারাবন্দী।

এদিকে রাসেলের বিরুদ্ধে মন্টি যে ধর্ষণের মামলাটি করেছেন, সেটি তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইমরান হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুটি মুঠোফোনে ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো সিআইডির কাছে পাঠানো হয়েছে। সিআইডির প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এসআই আরও বলেন, মারধর ও মুক্তিপণের ঘটনার রাসেল হাসান পুলিশকে জানাননি।

র‌্যাব-১১–এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রাসেল হাসানের লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করছি। আশা করছি, এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শিগগিরই আইনের আওতায় আনতে পারব।’