করোনার ধাক্কা দেশের পর্যটনশিল্পেও

বাংলাদেশে এখন পর্যটন মৌসুম। ফাইল ছবি
বাংলাদেশে এখন পর্যটন মৌসুম। ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে দেশের পর্যটন খাতে। বিদেশি পর্যটক আসার হার যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে দেশের বাইরে ভ্রমণমুখী মানুষের সংখ্যাও। এতে ভ্রমণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন এয়ারলাইনসের টিকিট বুকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও হোটেলগুলো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। পর্যটন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এই সময় তাঁদের ব্যবসা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ।

বৈশ্বিক পর্যটনবিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আসা (ইনবাউন্ড) মোট বিদেশি পর্যটকের ১৯ শতাংশ চীনা নাগরিক। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে প্রকাশিত বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যে আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশে মোট বিদেশি পর্যটকের ৪৯ শতাংশ আসে পাশের দেশ ভারত থেকে, এরপরই বেশিসংখ্যক মানুষ আসে যথাক্রমে চীন, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

বাংলাদেশে এখন পর্যটন মৌসুম। এ সময় বেশিসংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু সেই সংখ্যা এবার কম। করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটন ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন উল্লেখ করে ভ্রমণ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আকাশবাড়ি হলিডেজের মালিক তৌহিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা ৫০ শতাংশ কমেছে। অনেকে আগাম বুকিংও বাতিল করেছে। নতুন করে বুকিংয়ের হারও অনেক কম।’

তৌহিদুল আলমের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৫ হাজার মানুষ চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেতেন। গত দুই মাসে এখন সেই সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। তিনি বলেন, চীনের পর সবচেয়ে প্রভাব পড়েছে সিঙ্গাপুর ভ্রমণের ক্ষেত্রে। সিঙ্গাপুরগামী মানুষের সংখ্যা একেবারে কমেছে। এখন তো ইউরোপের দেশগুলোর ভ্রমণ প্যাকেজ ও টিকিট সংগ্রহেও মানুষ অনাগ্রহ দেখাচ্ছে।

একই তথ্য দিলেন জার্নি ওয়ালেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত যাঁরা ব্যবসায়িক কাজে টিকিট সংগ্রহ করতেন, তাঁরা প্রায় সবাই ভ্রমণ বাতিল করেছেন। এভাবে চলতে থাকলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।’

গত বছরের শেষ দিকে করোনাভাইরাস চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকেই বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করে। সতর্কতা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও)। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সতর্কতা রয়েছে। এসব তথ্য উল্লেখ করে বাংলাদেশ ইনবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডি ইনবাউন্ড) সভাপতি রেজাউল ইকরাম বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা ৫০ শতাংশ কমেছে। সব মিলে আমরা আতঙ্কিত। আমাদের পর্যটন বাজারটা ছোট। দুই মাস পর কী হবে, তা নিয়ে সবাই চিন্তিত।’

পর্যটন ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অন্যান্য বছর এই সময় ঈদের বুকিং শুরু হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা প্যাকেজ নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু এবার এখনো আগাম বুকিং শুরুই করা যায়নি।

চলতি মাসের গোড়ার দিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে চীনের নাগরিকদের অন-অ্যারাইভাল (আগমনী) ভিসা দেওয়া সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। হোটেল ও রিসোর্টগুলোতেও এর প্রভাব পড়েছে। অনেক হোটেলে অতিথিরা আগাম বুকিং বাতিল করেছেন, মার্চ মাসের যেসব বুকিং করা আছে, সেগুলোও বাতিলের আশঙ্কা করছে হোটেল কর্তৃপক্ষ।

দেশের অভিজাত হোটেল ও রিসোর্ট প্রতিনিধিদের সংগঠন বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিহা) সাধারণ সম্পাদক মোহসিন হক প্রথম আলোকে বলেন, হোটেল খাতেও করোনাভাইরাস বেশ ভালো প্রভাব ফেলেছে। মার্চের মাঝামাঝি পর্যায়ে এই অবস্থা আরও প্রকট হবে।

৫২টি হোটেলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মোহসিন হক বলেন, ‘৭০ শতাংশ ব্যবসা কমেছে দেশের আন্তর্জাতিক মানের এই হোটেলগুলোর। আসছে দিনগুলোতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। জানি না আমরা কীভাবে এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠব।’

এদিকে পর্যটন খাতের আকস্মিক পরিস্থিতি নিয়ে শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক (বিক্রয় উন্নয়ন ও জনসংযোগ) জিয়াউল হক হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের ব্যাপারে আমাদের সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। সত্যি বলতে, করোনাভাইরাসের প্রভাব সারা বিশ্বের পর্যটনশিল্পেই পড়েছে। বাংলাদেশেও বিদেশি পর্যটক কমেছে। মাস দু-এক পর হয়তো সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাবে। সবকিছু মিলে করোনাভাইরাস পর্যটনশিল্পের জন্য ধাক্কাই বটে।’ তিনি জানালেন, ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি করার ব্যাপারে তাঁদের আলোচনা হয়েছে। এই সংকট কীভাবে কাটিয়ে তোলা যায়, সে বিষয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে মন্ত্রণালয়।