মধুর সময় কাটাচ্ছে 'পদ্মা' ও 'গড়াই'

পদ্মা ও গড়াই। রাজশাহীর শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান চিড়িয়াখানায়।  প্রথম আলো
পদ্মা ও গড়াই। রাজশাহীর শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান চিড়িয়াখানায়। প্রথম আলো

তারা গায়ে গা লাগিয়ে রৌদ্রস্নান করে। একসঙ্গে ডুবসাঁতার খেলে। আড়াই বছর আগে ৪০ বছর বয়সী পদ্মা ও গড়াইয়ের এমন দিন ছিল না। পদ্মার একজন সঙ্গী ছিল, সেও তার মতোই মেয়ে। আর গড়াই থাকত তিন পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে। ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট তাদের সঙ্গী পাল্টে দেওয়া হয়। শুরু হয় তাদের নতুন জীবন।

এই ‘পদ্মা’ ও ‘গড়াই’ আসলে মিঠাপানির বিরল প্রজাতির কুমির—ঘড়িয়াল। এরা এখন বিলুপ্তির পথে। তাই আড়াই বছর আগে এদের রাজশাহীতে এ এইচ এ কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় আবদ্ধ জায়গায় প্রজননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন ঘটনাটি লোকমুখে ‘ঘড়িয়ালের বিয়ে’ বলে জনশ্রুতি পেয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে একটি পুরুষ ঘড়িয়ালকে ‘বর’ হিসেবে রাজশাহীতে আনা হয়। রাজশাহী চিড়িয়াখানার পুকুরে থাকা ‘কনে’ মাদি ঘড়িয়ালের সঙ্গে জোড়া বেঁধে দেওয়ার সময় ঢাকা থেকে আনা পুরুষ ঘড়িয়ালটির নাম দেওয়া হয় ‘গড়াই’। আর রাজশাহীর মাদি ঘড়িয়ালটির নামকরণ হয় ‘পদ্মা’। ওই দিন পদ্মা আর গড়াইয়ের ‘বিয়ে’ নিয়ে চিড়িয়াখানায় ব্যাপক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।

এর আগে রাজশাহীতে ছিল দুটি মাদি ঘড়িয়াল। তার একটি ঢাকা চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছিল চারটি ছেলে ঘড়িয়াল। ঢাকায় ছাড়ার সময় রাজশাহী থেকে নিয়ে যাওয়া মাদি ঘড়িয়ালটির নাম দেওয়া হয় ‘যমুনা’। এই বিনিময়প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঢাকা চিড়িয়াখানায় যমুনা পায় তিনটি ছেলে সঙ্গী। আর রাজশাহী চিড়িয়াখানারপদ্মা পায় গড়াইকে। রাজশাহী-ঢাকা চিড়িয়াখানা ও বন বিভাগের সহযোগিতায় ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এই আন্তচিড়িয়াখানা ঘড়িয়াল বিনিময়ের উদ্যোগ নেয়।

রাজশাহী চিড়িয়াখানার কিউরেটর ও ইনচার্জ ফরহাদ উদ্দিন জানান, প্রথম থেকেই তাঁরা গড়াই ও পদ্মার আচরণের দিকে নজর রাখছিলেন। প্রথম দিকে তারা দূরে দূরে থাকত। এ নিয়ে তাঁরা ভয় পাচ্ছিলেন, যদি বন্ধুত্ব না হয়, তাহলে মারামারি-কামড়াকামড়ি করতে পারে। তাদের কাছাকাছি আনার জন্য প্রথমে দুই জায়গায় তাদের খাবার দিতেন। আস্তে আস্তে খাবার দেওয়ার জায়গার মাঝের দূরত্ব কমিয়ে আনতে শুরু করেন। এ সময় তাঁরা খেয়াল করেন যে ঘড়িয়াল দুটি মারামারি করছে কি না। একপর্যায়ে দেখলেন, তারা মারামারি করে না। তখন এক জায়গায় খাবার দেওয়া শুরু করেন। এভাবে এক জায়গায় খাবার খেতে খেতে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এরপর থেকে তাঁরা আবদ্ধ জায়গায় প্রজননের (ক্যাপটিভ ব্রিডিং) ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠেন।

সাধারণত এপ্রিল-মে মাসের দিকে ঘড়িয়াল ডিম দেয়। ডিম বালুর মধ্যে পুঁতে রেখে বাচ্চা ফোটায়। গত বছরের জুন-জুলাইয়ের দিকে ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ের এই বিরল ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। পদ্মা সে সময় দুটি ডিম দেয়। কিন্তু ডিম দুটি নষ্ট অবস্থায় পানিতে পাওয়া যায়। পুকুরের মাঝখানে ডিম দেওয়ার জন্য যে বালুর ঢিবি করা হয়েছিল, সেটি অনেক ছোট ছিল। এবার সেই জায়গাটি বড় করা হয়েছে, যাতে পদ্মা বালুর ভেতরে ডিম পুঁতে রাখতে পারে। তা ছাড়া একটা ইনকিউবেটর নেওয়া হয়েছে। ডিম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাখা হবে সেখানে। ফরহাদ উদ্দিন বলেন, ঢাকা চিড়িয়াখানায় তাঁরা কোনো ডিম পাননি। রাজশাহীতে ডিম পাওয়া গেছে। এ থেকে তাঁরা আশাবাদী। সেই আশা থেকে সব চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে ঘড়িয়ালের খাঁচার কাছে না ঘেঁষার জন্য দর্শনার্থীদের উদ্দেশে নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আইইউসিএনের মুখ্য গবেষক এ বি এম সারোয়ার আলম বলেন, দেশে এর আগে কোথাও ঘড়িয়ালের ‘ক্যাপটিভ ব্রিডিং’ হয়নি। রাজশাহীতে যদি সফল হয়, তাহলে এটা হবে বিরল ঘটনা।

উপমহাদেশীয় এই কুমির সাধারণত মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে। এর মূল আবাসভূমি গঙ্গা (পদ্মা) নদী বলে এর বৈজ্ঞানিক নামকরণও (Gavialis gangeticus)হয়েছে গঙ্গার নামে। তবে গঙ্গা ছাড়াও উপমহাদেশের অন্যান্য বড় নদীতেও আগে ঘড়িয়াল দেখা যেত। বাংলাদেশে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র এবং সেগুলোর শাখা-প্রশাখায় একসময়প্রচুর ঘড়িয়াল দেখা যেত। কিন্তু আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ার কারণে বাংলাদেশে প্রজননক্ষম ঘড়িয়াল বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশে ঘড়িয়াল বর্তমানে মহাবিপন্ন বন্য প্রাণী, যা বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ দ্বারা সংরক্ষিত।

বর্তমানে সারা দেশে তিনটি চিড়িয়াখানা এবং একটি সাফারি পার্ক মিলিয়ে মোট ১২টি ঘড়িয়াল আবদ্ধ পরিবেশে জীবিত রয়েছে। আর আইইউসিএনের তথ্যমতে, সারা পৃথিবী মিলিয়ে ঘড়িয়াল টিকে রয়েছে মাত্র ২০০টির কম। এরা বন্য পরিবেশে ৫০-৬০ বছর বেঁচে থাকে। কোনো কোনোটি ১০০ বছর পর্যন্তও বাঁচতে পারে। একেকটি সাধারণত ৫-৬ মিটার লম্বা হয়, কুমিরজাতীয় প্রাণীর মধ্যে এরা দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রজাতি।