করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর প্রস্তুতিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ

নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশে তার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা নজরদারির কাজটিও সঠিকভাবে হচ্ছে না। করোনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কোন পর্যায়ে, তার কোনো মূল্যায়নও এখনো হয়নি।

বার্ড ফ্লু ও পরবর্তী সময়ে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কমিটি হয়েছিল, কারিগরি কমিটিও হয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো কমিটি বা কোনো কারিগরি কমিটিহয়নি। সিদ্ধান্ত কারা, কীভাবে নিচ্ছে, বিষয়গুলো পরিষ্কার নয়।

গত শুক্রবার করোনা বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের যৌথ মিশন প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশের প্রস্তুতির বিষয়গুলো নতুন করে সামনে এসেছে। এরই মধ্যে বিশ্ব সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে বলে স্বাস্থ্যসতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সপ্তাহ দুই আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিস্থিতিকে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা বলে ঘোষণা করেছিল। সর্বশেষ গতকাল কাতার ও ইকুয়েডরে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো একজন মারা গেছেন।

এ নিয়ে বিশ্বে মোট রোগীর সংখ্যা ৮৫ হাজার ছাড়াল। শুধু চীনে আক্রান্ত ৭৯ হাজার ২৫১ জন। চীনের বাইরে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দক্ষিণ কোরিয়ায়। গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ১০০ জনের বেশি।

চীনের বাইরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৯৬ হয়েছে। তাদের মধ্যে ইরানে ৪৩ জন, ইতালিতে ২১ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬ জন, জাপানে ১০ জন। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইতালিতে পাঁচটি ফুটবল ম্যাচ স্থগিত হয়েছে।

যৌথ মিশনের সুপারিশ ও প্রস্তুতি

চীন, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, নাইজেরিয়া, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২৫ জন বিশেষজ্ঞ করোনা বিষয়ে যৌথ মিশনের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। ১৬–২৪ ফেব্রুয়ারি যৌথ মিশনের প্রতিনিধিরা চীন ভ্রমণ শেষে ৪০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন তৈরি করেন।

যৌথ মিশনের একটি উদ্দেশ্য ছিল চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে জ্ঞান ও ধারণা দ্রুত বাড়ানো। পাশাপাশি আক্রান্ত ও ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করা। যৌথ মিশন প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, সংক্রমণ দেখা দেয়নি এমন দেশগুলোতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জরুরি সতর্কতা ব্যবস্থা সক্রিয় করা দরকার, যাতে প্রাদুর্ভাব বন্ধে সরকার ও সমাজ সামগ্রিকভাবে সম্পৃক্ত হয়। ‘কোভিড–১৯’ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা বা জ্ঞান কতটুকু, তারও একটি তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন দরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারিবিষয়ক প্রস্তুতি কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর প্রস্তুতিতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থাকে যুক্ত করা দরকার। যেকোনো সিদ্ধান্ত কোনো কমিটির মাধ্যমে আসা দরকার। জরুরি কোনো সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হলে সেই সিদ্ধান্ত কে নেবে?

>

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের যৌথ মিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশের পর প্রস্তুতির বিষয়টি সামনে এসেছে।

কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর ক্ষেত্রে এ রকম কোনো কমিটি এখনো তৈরি হয়নি। করোনার বিষয়ে সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলছেন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা। গতকাল শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কমিটি নেই ঠিকই; স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, করোনাবিষয়ক একটি পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। তাতে কমিটি গঠনের বিষয়গুলো থাকছে।

যৌথ মিশন প্রতিবেদনে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা নজরদারির ব্যবস্থাকে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। ১৮টি এলাকার (হাসপাতাল) তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা পরিস্থিতি দেখা হয়। এগুলোর মধ্যে ১০টি এলাকা নজরদারি করে আইইডিসিআর। ৮টি এলাকা নজরদারি করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)।

মীরজাদী সেব্রিনা বলেছেন, তাঁরা সব এলাকা থেকে তথ্য পাচ্ছেন। তবে অন্য একটি সূত্র বলছে, সরকারের কাছ থেকে কোনো নির্দেশ না আসায় আইসিডিডিআরবির এলাকাগুলো সক্রিয় করা হয়নি।

মানুষকে সচেতন করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট সুপারিশ আছে যৌথ মিশনের প্রতিবেদনে। ‘কোভিড–১৯’ বিষয়ে সাধারণ মানুষের জ্ঞান বা ধারণা কী, তার একটি ত্বরিত মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে। তার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যবার্তাগুলো পুনর্বিন্যাস করতে হবে বা ঢেলে সাজাতে হবে এবং সেই অনুযায়ী তা ব্যবহার করতে হবে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে সফলদের গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তবে এসব বিষয়ে এখনো তেমন কিছু শোনা যায়নি।

এ ব্যাপারে মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘দৈনিক সংবাদ ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে আমরা দেশবাসীকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানোর পাশাপাশি সচেতন করার চেষ্টা করছি।’

এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, সরকারি কর্মকর্তারা যৌথ মিশন প্রতিবেদন দেখেছেন।’

দেশে এ পর্যন্ত ৮৭ জনের লালা বা রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে আইইডিসিআরের ল্যাবরেটরিতে। কেউ আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়নি।

আইইডিসিআর জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরে বর্তমানে তিনজন বাংলাদেশি ‘কোভিড–১৯’ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অসুস্থ বাংলাদেশির পরিস্থিতি স্থিতিশীল।

নীলফামারীতে হঠাৎ অসুস্থ ২৯

প্রথম আলোর নীলফামারীর প্রতিনিধি জানান, গতকাল নীলফামারীর ইপিজেড এলাকার একটি চীনা কারখানায় গণহিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২৯ জন শ্রমিক হাসপাতালে ভর্তি হন। রাত আটটার দিকে সবাই সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান।

নীলফামারী সদর হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে আসা শ্রমিকেরা প্রত্যেকে একই রকম উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এঁরা প্রত্যেকে আতঙ্কের কারণে অসুস্থ হয়েছিলেন। সবাই শঙ্কামুক্ত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সকাল সাতটার দিকে শ্রমিকেরা কারখানায় কাজ শুরু করেন। সকাল ১০টার দিকে দুজন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁদের সদর হাসপাতালে আনা হয়। এরপর একে একে শ্রমিকেরা অসুস্থ হতে থাকেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করে। পাশাপাশি অসুস্থ ব্যক্তিদের হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এতে হাসপাতালে অন্য রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে ধারণা করেন, নতুন রোগীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। হাসপাতালও কেউ কেউ ছেড়ে যান। রাতেও অনেকে ফেরেননি।