৫ অভয়াশ্রমে ২ মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ

কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে মৎস্য আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবেন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে মৎস্য আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবেন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

দেশের ইলিশের ছয় অভয়াশ্রমের মধ্যে পাঁচটিতে সব ধরনের মাছ ধরার ওপর দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। গতকাল শনিবার মধ্যরাত থেকে এই নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা চলবে। 

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলাসংলগ্ন আন্ধারমানিক নদের ৪০ কিলোমিটার আয়তনের অভয়াশ্রমটি এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই। এখানে গত নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর—দুই মাস নিষেধাজ্ঞা ছিল। মাছের প্রজননকাল, চলাচলের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে ওই অভয়াশ্রমে প্রতিবছর আগেভাগেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ইলিশ সম্পদ বাড়াতে সরকার জাটকা নিধন রোধে ২০০৬ সাল থেকে দেশের অভয়াশ্রমগুলোয় নিষেধাজ্ঞা কার্যক্রম শুরু করে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এবারও মার্চ থেকে এপ্রিল—এই দুই মাস অভয়াশ্রমগুলোয় ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলেরা সরকারি সহায়তা পাবেন। আর কেউ এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে মৎস্য আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবেন। নিষেধাজ্ঞাকালে এসব এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানসহ সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা থাকবে।

দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিবছর ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আট মাস জাটকা (১০ ইঞ্চির চেয়ে ছোট ইলিশ) ধরা, পরিবহন ও বিক্রি নিষিদ্ধ থাকে। এ মৌসুমেও একইভাবে গত নভেম্বর থেকে চলছে নিষেধাজ্ঞা। তা থাকবে ৩০ জুন পর্যন্ত। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পাঁচ অভয়াশ্রমে নতুন করে সব ধরনের ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো।

এ ছাড়া গত বছর প্রথম সব ধরনের মাছের উৎপাদন বাড়াতে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। আগে এই নিষেধাজ্ঞা কেবল দেশের ২৫৫টি বাণিজ্যিক ফিশিং বোটের জন্য বলবৎ ছিল। গতবারই প্রথম সাগরে মাছ আহরণের জন্য ব্যবহৃত যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক সব ধরনের নৌযানকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়।

মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, আগে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ঘিরে পাঁচটি অভয়াশ্রম ছিল। কিন্তু গত বছর অভয়াশ্রমের সংখ্যা আরও একটি বেড়ে ছয়টি হয়েছে। এসব অভয়াশ্রম হলো—পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আন্ধারমানিক নদের ৪০ কিলোমিটার, চরইলিশার মদনপুর থেকে ভোলার চরপিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর ৯০ কিলোমিটার, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর চররুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার, চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচরের ৭০ কিলোমিটার, লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর ৩০ কিলোমিটার ও শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত নিম্ন পদ্মার ২০ কিলোমিটার এলাকা।

গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠ অভয়াশ্রমের গেজেট প্রকাশিত হয়। নতুন অভয়াশ্রমের সীমানা হলো বরিশাল সদর উপজেলার কালাবদর নদের হবিনগর পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জের বামনীরচর পয়েন্ট পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার, মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীর হাটপয়েন্ট থেকে হিজলা লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার, হিজলার মেঘনার মৌলভীরহাট পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জসংলগ্ন মেঘনার দক্ষিণ-পশ্চিম জাঙ্গালিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার। এই সীমানার মধ্যের নদ-নদীগুলো হচ্ছে কালাবদর, আড়িয়ালখাঁ, নয়ভাঙ্গুলী, গজারিয়া ও কীর্তনখোলা। অর্থাৎ বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জসংলগ্ন মেঘনার শাখা নদীগুলো এর আওতায় রয়েছে।

আট মাসের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ২০ জেলার ২ লাখ ৮০ হাজার ৯৬৩টি জেলে পরিবারকে মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় দুই ধাপে ৮০ কেজি করে চাল সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার ১ লাখ ৭২ হাজার জেলে এই সহায়তা পাবেন।

বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালক আজিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ছয়টির মধ্যে পাঁচটি অভয়ারণ্যে এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।

মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারের এই উদ্যোগে দেশে ইলিশের উৎপাদন অনেকাংশে বেড়েছে। দেশে মোট ইলিশ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় অবদান বরিশাল বিভাগের। দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ইলিশ আহরিত হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৮৮ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগ থেকেই আহরিত হয় ৩ লাখ ৩২ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। এর আগের অর্থবছরে দেশে আহরিত মোট ইলিশের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বরিশাল থেকে আহরিত হয় ৩ লাখ ২৪ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন, যা দেশে মোট উৎপাদনের প্রায় ৬৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে অনুযায়ী বরিশালেও তা প্রায় ৮ হাজার মেট্রিক টন বৃদ্ধি পায়।

চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জীবনচক্র সম্পূর্ণ করতে পারার জন্য গেল মৌসুমে ইলিশ পুরোপুরি প্রজননে অংশ নিতে পেরেছে। ফলে ইলিশ উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে দীর্ঘ সময় নদী ও সাগরে পরিভ্রমণ করতে পেয়ে আকারেও বড় হচ্ছে ইলিশ।