গানের মানুষ রমজান

গান গাইছেন রমজান আলী। সম্প্রতি শ্রীপুরের বড়বাইদ বটতলা বাজারে।   ছবি: প্রথম আলো
গান গাইছেন রমজান আলী। সম্প্রতি শ্রীপুরের বড়বাইদ বটতলা বাজারে। ছবি: প্রথম আলো

সন্ধ্যার সুনসান গ্রাম বড়বাইদ। বনের ভেতর চলে যাওয়া সড়কের মাথায় বড়বাইদ বটতলা বাজার। বটতলা গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের একটি এলাকা। ছোট আকারের ১০-১২টি দোকানের মাঝখানে বটগাছ। সেখান থেকে ভেসে আসছিল হৃদয়স্পর্শী গানের সুর। দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ ডিম বিক্রি করতে করতে আপন মনে গান গাচ্ছিলেন। গানের শ্রোতা ছয়-সাতজন বিভিন্ন বয়সী মানুষ।

ওই বৃদ্ধের নাম রমজান আলী (৬৩)। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি। জানা গেল, তিনি এ বাজারে নিয়মিত সেদ্ধ ডিম বিক্রি করেন। তবে ভিন্নতা এই যে তিনি যখন-তখন ডিম বিক্রি করতে করতে গান ধরেন। গ্রামের সব বয়সীর কাছে তিনি গানের মানুষ।

সম্প্রতি সন্ধ্যার পর ওই বাজারে গিয়ে দেখা যায়, রমজান আলীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে, বসে অনেক ক্রেতা। একটু পরপর গানে টান দিচ্ছেন তিনি। কখনো ‘ভালোবাসা যদি যন্ত্রণা হয়...’, ‘আমি রূপসাগরের ওপার থেকে তোমায় দেখেছি...’, কিংবা ‍‘মুখ দেখে ভুল করো না, মুখটা তো নয় মনের আয়না...’ এমন সব গান তুলছেন কণ্ঠে। শরীরে বয়সের ছাপ পড়া এই বৃদ্ধ বিরামহীনভাবে গান গেয়ে যাচ্ছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি বললেন, ‘এইংনা গাহান আহনেরা হুনবেন? আগে ছোডো সময় গাইতাম। এইংনা গভীর প্রেমের গাহান। যার মনের ভেতর প্রেম নাই, হে এইংনা গাহান বুঝব না।’

কৃষিনির্ভর এই গ্রামের মানুষ দিনভর জমিতে কাজ করে বিকেল হলেই বাজারে আড্ডা জমায়। বাজারটিতে নিয়মিত রাত ১০টা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের আড্ডা জমে। আড্ডার মধ্যমণি রমজান আলী। ছোট সময় গান গাইতেন বন্ধুবান্ধবের মধ্যে। এখন তাঁর সন্তানেরা বড় হয়েছে। সচ্ছল তাঁর পরিবার। এ সময় একটু আনন্দে কাটানোর জন্য তিনি প্রায়ই গান ধরেন। গ্রামের মানুষ তাঁর গান এখনো শোনেন বলে তাঁর আনন্দ হয়।

ডিম বিক্রি হয় কেমন, জিজ্ঞেস করলে রমজান আলী বলেন, ‘আসলে সময় কাটানোর লাইগ্গা ডিম বেচি। সবার সাথে একটু কথা কওয়া যায়, একটু আনন্দে কাটানো যায়। তাই বাজারে আইয়া আড্ডা দিতে দিতে ডিম বেচি।’ তিনি জানান, একসময় গ্রামাঞ্চলে মানুষ অনেক বেশি উৎসবপ্রিয় ছিল। বাঙালি সংস্কৃতির প্রায় সব আচার অনুষ্ঠানগুলো গ্রামাঞ্চলে গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হতো। যখন-তখন গ্রামের রাস্তার পাশে কিংবা জমিতে কাজের ফাঁকে গানের আড্ডা জমে যেত। কিন্তু সময়ের আবর্তে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে। তাঁর ধারণা, এখন মানুষের মধ্যে তেমন আবেগ নেই। মানুষের মধ্যে প্রেম কমে গেছে। প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।

রমজান আলী বলেন, ‘গ্রামের সন্ধ্যাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় মানুষজন তাঁদের কাজ শেষে একত্র হয়। এই সময়টাতেই আনন্দ করা দরকার। আমি আনন্দ দিই।’

মো. আবদুল্লাহ নামের স্থানীয় একজন বলেন, ‘রমজান আলী দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বন্ধু, হৃদয়ের মানুষ। সব বয়সীর কাছেই তিনি প্রিয়। মজা করতে পছন্দ করেন। গানে গানে যেকোনো আড্ডা জমিয়ে দিতে পারা মানুষ তিনি।’ স্থানীয় সোলাইমান মিয়া বলেন, ‘আমরা ছোট থেকেই তাঁকে চিনি। প্রচণ্ড বন্ধুবৎসল মানুষ। যখন-তখন হাসতে পারেন, হাসাতে পারেন। বাজারে তিনি প্রায়ই আড্ডা জমান। খুব ভালো মনের মানুষ তিনি।’

অশীতিপর গফুর মিয়া বলেন, ‘বহু আগে থেকেই রমজান আলীর গান শুনছি। সে সব সময় হাসিখুশি মানুষ। কণ্ঠটা দারুণ। সব সময় তাকে দেখি, আবদুল জব্বারের গান গাইতে। মাঝেমধ্যে অন্যান্য গানও গায়।’