করোনাভাইরাসে দিশাহীন বিশ্ব

>এমন শ্বাসতন্ত্রের জীবাণু এর আগে দেখা যায়নি। প্রতিরোধে বাংলাদেশে তিন স্তরের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত।

প্রতিদিন নতুন নতুন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত চীনসহ ৭৫টি দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাস ছড়ানোর তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ এসব দেশ ও অঞ্চলে বাস করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিস্থিতিকে দিকদিশাহীন বলে বর্ণনা করেছে। এমন শ্বাসতন্ত্রের জীবাণু এর আগে দেখা যায়নি।

কোনো সাধারণ নিয়ম মেনে নতুন এই ভাইরাস দেশ থেকে দেশে ছড়াচ্ছে না। প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রে সংক্রমণের ধরন আলাদা বলেই মনে হচ্ছে। দুই মাসের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে ৯১ হাজারের বেশি মানুষ। তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আগেভাগে ও আগ্রাসী পদক্ষেপ নিলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ এবং জীবন রক্ষা করা সম্ভব।

তবে বাংলাদেশে এখনো কেউ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়নি। ‘কোভিড–১৯’ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তিন স্তরের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। জেলা পর্যায়ের কমিটির প্রধান থাকবেন জেলা প্রশাসক; আর উপজেলা পর্যায়ের কমিটির প্রধান হচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন। 

বিশ্ব পরিস্থিতি তুলে ধরার সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, অনেক দেশে সভা, সেমিনার, অনুষ্ঠান বাতিল করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ১০০ বছরে একবার আমরা পাব। যেহেতু দেশে এখন পর্যন্ত একজনও করোনাভাইরাসের রোগী পাওয়া যায়নি, কাজেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের কোনো অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে না।’ তিনি আরও জানান, করোনাভাইরাস–বিষয়ক একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা ‘কোভিড–১৯’ চিকিৎসাবিধি (ট্রিটমেন্ট প্রটোকল) তৈরি করেছেন। 

কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে এবার চীনের পর ইতালি, ইরান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের জন্য আগমনী ভিসা আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। 

পাশাপাশি ওই তিন দেশের নাগরিকেরা বাংলাদেশে আসতে চাইলে সেখানকার মিশনগুলোতে ভিসার আবেদনের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে চিকিৎসকের সনদ দিতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান।

 বৈশ্বিক পরিস্থিতি

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করোনাভাইরাস সংক্রমণের হালনাগাদ তথ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের গতকালের (বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটা) হিসাব অনুযায়ী, ৭৫টি দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ৯১ হাজারের বেশি। মোট মৃত্যু ৩ হাজার ১১৮। চীনের পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দক্ষিণ কোরিয়ায়। দেশটিতে ৫ হাজার ১৪৬ জন আক্রান্ত হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় ইরানে আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও মৃত্যু সেখানে বেশি। ইরানে ১ হাজার ৫০১ জন আক্রান্ত হয়েছে, আর মারা গেছে ৬৬ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি দল ইরান সরকারকে সহায়তা করার জন্য সে দেশে গেছে।

গত সোমবার জেনেভায় সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস অ্যাডহানম গ্রেব্রেইয়েসুস বলেন, ‘আমরা এখন দিকদিশাহীন পরিস্থিতিতে। কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম এমন শ্বাসতন্ত্রের জীবাণু আমরা আগে দেখিনি। কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ নিলে এই ভাইরাসকে সংযত রাখা যায়।’ তিনি বলেন, অগ্রাধিকারের তালিকায় শীর্ষে রাখতে হবে ভাইরাস সংযত রাখার বিষয়টিকে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় আয়োজন স্থগিত হচ্ছে। টোকিও অলিম্পিকের দায়িত্ব পাওয়া জাপানের মন্ত্রী বলেছেন, টোকিও অলিম্পিক গেমস ২০২০ স্থগিত হতে পারে। যদিও আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) বলেছে, কমিটি টোকিও অলিম্পিক সফল করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কমিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুসরণ করবে উল্লেখ করে আইওসির প্রেসিডেন্ট থমাস বাচ বলেন, ‘সব ক্রীড়াবিদকে প্রস্তুতি অব্যাহত রাখতে উৎসাহ দিচ্ছে আইওসি।’

যুক্তরাষ্ট্রে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত ১০৬ জন আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে মারা গেছে ৬ জন।

ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ইতিমধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে।

ভারতে এ পর্যন্ত ১১ জন আক্রান্তের খবর দিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। গত সোমবার দিল্লি ও তেলেঙ্গানায় একজন করে শনাক্ত হন। গতকাল আগ্রার এক পরিবারে ৬ জন শনাক্ত হয়েছে।

সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত পাঁচ বাংলাদেশির চারজন সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন। কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত প্রথম বাংলাদেশি এখনো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আছেন। আরব আমিরাতে আক্রান্ত বাংলাদেশির অবস্থা অপরিবর্তিত বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।

 বাংলাদেশ পরিস্থিতি

আইইডিসিআর তাদের ল্যাবরেটরিতে এ পর্যন্ত ১০২ জনের লালা বা রক্তের নমুনা পরীক্ষা করেছে। এসব মানুষ মূলত চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। এঁদের প্রায় অর্ধেক বাংলাদেশি। কারও শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়নি। 

গতকাল নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, পাঁচজন রোগীকে হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিটে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

বিদেশিরা এসে অবস্থান করেন এমন হোটেল কর্মকর্তাদের নিয়ে গতকাল একটি অবহিতকরণ সভা করেছে আইইডিসিআর। সভায় হোটেল কর্তৃপক্ষের করণীয় বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আক্রান্ত দেশ থেকে কেউ এসে হোটেলে উঠলে তাদের তালিকা আইইডিসিআরে পাঠাতে বলা হয়েছে।  

এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, বিদেশি হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভর্তি করতে ও চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এমন ঘটনা ঘটেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট খোলার কথা বলা হয়েছে।

বিদেশ থেকে এসে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে নানা সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বিদেশফেরত যুবককে ঘিরে এমন সন্দেহ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রথম আলোর নওগাঁ প্রতিনিধি। 

সিঙ্গাপুরের একটি জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করেন ওই যুবক। গত শুক্রবার তিনি দেশে ফিরেছেন। বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কিছু ধরা পড়েনি। রোববার রাতে তাঁর জ্বর, সর্দি ও মাথাব্যথা শুরু হয়। গত সোমবার প্রথমে তাঁকে নিয়ামতপুর উপজেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোমিনুল হক বলেছেন, ওই যুবকের রক্ত ও লালার নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।