গোপালগঞ্জ জেলার সড়ক প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে

গোপালগঞ্জ জেলার সড়ক প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। জেলায় বছরে গড়ে ১০০–এর মতো মানুষের প্রাণ যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। বিশেষ করে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের যে অংশটুকু গোপালগঞ্জের ওপর দিয়ে গেছে, সেখানে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে সড়কের ত্রুটি, অবৈধ যানবাহনের চলাচল এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব—এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ। একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলেও সড়কের ত্রুটি সারানো বা অবৈধ যান চলাচল বন্ধ হচ্ছে না।

গত রোববার গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার ছাগলছিড়া এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। পাঁচ বন্ধু মিলে কুয়াকাটায় বেড়ানো শেষে গাড়িতে করে সকালে ঢাকায় ফিরছিলেন। এ সময় ছাগলছিড়া এলাকায় গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে গাড়ির গ্যাসের সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন ধরে যায়। আরোহীদের সবাই দগ্ধ হয়ে মারা যান। ছাগলছিড়াসহ জেলার চারটি স্থানকে অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে অনেক আগেই চিহ্নিত করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। 

সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক প্রতিকার চেয়ে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। এরপর মন্ত্রণালয় দুটি কমিটি গঠন করে। এই দুই কমিটির সদস্যরা গত বছরের অক্টোবরে ও ডিসেম্বরে গোপালগঞ্জ জেলার সড়কে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তাঁরা দুর্ঘটনার যেসব কারণ দেখতে পান, এর মধ্যে রয়েছে—সড়কের ত্রুটি, মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটিসহ অবৈধ যানের অবাধে চলাচল এবং বেপরোয়া গতি।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সড়কের ত্রুটি সারাতে, যানবাহনের গতিনিয়ন্ত্রণ কিংবা অবৈধ যানের চলাচল বন্ধে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

গোপালগঞ্জ জেলায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) আওতায় সড়ক আছে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৮০ কিলোমিটার ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তৈরি করে এআরআই। তাদের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে গোপালগঞ্জ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬০টি। এসব দুর্ঘটনায় ৯৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হন আরও ৪২৫ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, দুর্ঘটনার কারণ ও করণীয় নির্ধারণে সুপারিশসহ প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলন। 

এআরআই সারা দেশে ২০০টির বেশি অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানকে ব্ল্যাক স্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) একটি প্রকল্পের অধীনে ১৬৯টি স্থানে সড়কের বাঁক সম্প্রসারণসহ নানা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু এখনো বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়ে গেছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ জেলায় চারটি স্থান রয়েছে। এগুলো হচ্ছে মুকসুদপুর উপজেলার ছাগলছিড়া বাসস্ট্যান্ড, মুকসুদপুর বাসস্ট্যান্ড, কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া রেলওয়ে ওভারপাস এলাকা, গোপালগঞ্জ সদরের বেদগ্রাম এলাকা।

জানতে চাইলে গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহীদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি সরেজমিনে দেখে গেছে। এরপর কী হয়েছে তিনি জানেন না। তিনি বলেন, আসলেই গোপালগঞ্জে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। সচেতনতা সৃষ্টির কাজ তাঁরা করছেন। কিন্তু কারিগরি কোনো ত্রুটি আছে কি না, সেটা দেখার জন্যই মন্ত্রণালয় কাজ করছে।

 জেলা প্রশাসকের চিঠি পেয়ে প্রথমে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূর মোহাম্মদ মজুমদারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এতে সওজ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), গোপালগঞ্জ জেলা ও অন্য উপজেলা প্রশাসন, হাইওয়ে পুলিশ এবং এআরআই প্রতিনিধি রয়েছেন। তাঁরা গত বছরের ২ ও ৩ অক্টোবর গোপালগঞ্জ জেলায় অবস্থান করে বিভিন্ন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে জেলায় সংঘটিত ১০টি আলোচিত দুর্ঘটনার কারণ, দায়ী এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ওই ১০টি আলোচিত দুর্ঘটনার মধ্যে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গোপালগঞ্জ সদরের পশ্চিম হরিদাসপুরে। একটি দ্রুতগামী বাসের সঙ্গে মাহিন্দ্রের সংঘর্ষে ১২ জন মারা যান। এর ১১ জনই মাহিন্দ্রর যাত্রী। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মাহিন্দ্রটির মহাসড়কে চলাচলের অনুমতি ছিল না। আর বাসের চালকের লাইসেন্স ভুয়া। বাসটি বেপরোয়া গতিতে চলছিল। একটি মোটরসাইকেলকে বিপজ্জনকভাবে পেরিয়ে যাওয়ার (ওভারটেক) চেষ্টাকালে মাহিন্দ্রের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। 

এরপর বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মাহবুব ই রব্বানীর নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি করা হয়। তারা গোপালগঞ্জ সফর করে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর চারটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করে কিছু সমাধানের সুপারিশ করে। 

কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তদন্ত কমিটির সদস্যরা ছাগলছিড়া এলাকায় অবৈধভাবে নছিমন, করিমন, ভটভটি চলাচল করতে দেখেন। এ ছাড়া দুই লেনের সড়কের দুই পাশে বাড়তি কোনো স্থান (হার্ড শোল্ডার) পাননি। ফলে কোনো কারণে যানবাহনগুলো পিচঢালা সড়কের বাইরে গেলেই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। এ ছাড়া সড়কের দুই পাশেই ড্রেজিং পাইপ ফেলে রাখতে দেখেন, যা যান চলাচলের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। মহাসড়কের সঙ্গে অপরিকল্পিতভাবে আরেকটি ছোট সড়ক মিশেছে। সেই মিলনস্থলে দোকানপাট থাকায় মূল সড়কে দ্রুতগতিতে চলা যানবাহনের চালকেরা পাশের সড়কের যান দেখতে পান না, যা দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

জানতে চাইলে সড়ক মন্ত্রণালয়ের করা কমিটির সদস্য ও এআরআইয়ের গবেষক কাজী সাইফুন নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, গোপালগঞ্জে মহাসড়ক বেশ ভালো। তবে কিছু কিছু স্থানে নকশায় ত্রুটি আছে। অবৈধ যানবাহন ও বেপরোয়া গতি ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। প্রায় ৮০ কিলোমিটার মহাসড়কে একটিমাত্র হাইওয়ে থানা আছে। ফলে আইনের প্রয়োগও সেভাবে হয় না।