পাপিয়া-সুমনের সবকিছু জেনেও সবাই চুপ ছিল, এখন অস্বীকার

শামীমা নূর পাপিয়া।
শামীমা নূর পাপিয়া।

নরসিংদীর রাজনীতির অঙ্গনে তাঁদের চলাফেরা অনেক দিনের। মফিজুর রহমান চৌধুরী ওরফে মতি সুমন এবং শামীমা নূর ওরফে পাপিয়া দুজনই জেলার রাজনৈতিক মহলে অতিপরিচিত। এক দশকের মধ্যে শহরটির নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এই দম্পতি পাঁচ তারকা হোটেলের বিলাসবহুল স্যুটে ডেরা গেড়েছিলেন। বিপুল বৈভব আর রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ে তাঁদের যোগাযোগের কথাও নরসিংদীর মানুষের মুখে মুখে। তবে যাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের এই উত্থান, এখন তাঁরা দায় নিতে চান না।

পাপিয়া-সুমন দম্পতি সম্পর্কে জানতে কথা হয় নরসিংদী শহরের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ নানা পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, নরসিংদী পৌরসভার প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন মতি সুমন। সেই ২০০০ সাল থেকেই তিনি লোকমানের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। লোকমান হোসেনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক দেখা যেত তাঁকে, সবাই বলতেন ‘বডিগার্ড’। পুরস্কার হিসেবে তাঁকে শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়কের পদ দেন লোকমান। ২০০১ সালে নরসিংদী পৌরসভার ভেলানগরে যাত্রা প্যান্ডেলে পৌর কাউন্সিলর প্রকাশ মানিককে গুলি করে হত্যার অভিযোগ ওঠে মতি সুমনের বিরুদ্ধে। হত্যা মামলার আসামি হয়ে কিছুদিন পালিয়ে ছিলেন। ২০০৪ সালে আত্মসমর্পণ করে ছয় মাস কারাগারে ছিলেন, এরপর জামিন পান। এই হত্যা মামলায় মতি সুমনের সঙ্গে মেয়র কামরুজ্জামানও আসামি ছিলেন। তাঁদের প্রভাবের কারণে মামলাটির বিচার এখনো শেষ হয়নি বলে অভিযোগ আছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আবারও প্রকাশ্যে দেখা যায় মতি সুমনকে। তখন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর সঙ্গে দেখা যেত পাপিয়াকেও। ২০০৯ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। এরপর স্বামীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়ান পাপিয়া। যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি, মিছিল-সমাবেশের সামনে থাকতেন তাঁরা। স্বামীর মোটরসাইকেলের পেছনে বসে মহড়া দিতেন। একপর্যায়ে স্বামীর সঙ্গে অপরাধজগতেও পা বাড়ালে এলাকায় তাঁর নাম হয় ‘লেডি মাস্তান’। নরসিংদীর খুনোখুনির রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে এই বেপরোয়া দম্পতির সময় লাগেনি। জেলার সব প্রভাবশালী নেতার সঙ্গেই তাঁদের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

>

খুনের মামলার আসামি হয়েও নরসিংদী দাপিয়ে বেড়াতেন সুমন। তাঁকে বিয়ের পর অপরাধ জগতে পা বাড়ান পাপিয়া।

২০১১ সালের ১ নভেম্বর নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেন খুন হন। এরপর লোকমানের ছোট ভাই কামরুজ্জামান পৌর মেয়র হন। তখন তাঁর সঙ্গে ভিড়ে যান এই দম্পতি। কিন্তু ২০১২ সালে পাপিয়া হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কামরুজ্জামানের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। জেলার কেউ বলেছেন, নিজের কাছে থাকা পিস্তলের গুলিতে বিদ্ধ হয়েছিলেন পাপিয়া। আবার কেউ ধারণা করেন, তাঁকে গুলি করা হয়েছিল। তবে পৌর মেয়র কামরুজ্জামান বলেন, পাপিয়া নিজের কাছে থাকা পিস্তলের গুলিতে আহত হন।

মেয়র কামরুজ্জামানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে ঢাকায় চলে আসেন এই দম্পতি। ঢাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহলে তাঁদের যাতায়াত ছিল। ঢাকার যুব মহিলা লীগের কয়েকজন নেত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হন পাপিয়া।

শামীমা নূর পাপিয়ার বাড়ি।  ছবি: প্রথম আলো
শামীমা নূর পাপিয়ার বাড়ি। ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, পদ পাওয়ার পর এই দম্পতি প্রায় প্রতিদিনই নরসিংদী যেতেন। এলাকার স্থানীয় মানুষ তাঁদের কাছে নানা সমস্যা নিয়ে যেতেন। এমনকি যেসব রাজনৈতিক কর্মী পদবঞ্চিত ছিলেন, তাঁরাও পদ পেতে এই দম্পতির দ্বারস্থ হতেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাঁরা স্থানীয় কিছু তরুণীকে চাকরির লোভ দেখিয়ে ঢাকায় নিয়ে যান।

পদ পাওয়ায় পাল্টে যায় পৃষ্ঠপোষকতা। ২০১৮ সাল থেকে বর্তমান সাংসদ মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে দেড় থেকে দুই হাজার লোক নিয়ে উপস্থিত হতে দেখা যেত তাঁদের। আওয়ামী লীগের জাতীয় পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে এই সাংসদই তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেন বলে এলাকায় প্রচলিত আছে। আর নিজেদের ফেসবুক পাতায় এই দম্পতি নিয়মিতই জাতীয় নেতা, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে পোস্ট করতেন। এসবও জেলার রাজনীতিতে তাঁদের কদর বাড়িয়েছে।

সাংসদের অস্বীকার
তবে নরসিংদী-১ আসনের সাংসদ নজরুল ইসলাম সুমন-পাপিয়া দম্পতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা অস্বীকার করেছেন। পৌর মেয়রের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা একসময় পৌর মেয়র লোকমানের দেহরক্ষী ছিলেন। পৌর মেয়র তাঁদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সাংসদের দাবি, ২০১৪ সালে পাপিয়াকে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ দেওয়ার বিরোধিতা করেন তিনি।

তবে জেলার পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দীপক সাহা বলেন, এলাকার সবাই দেখেছেন, পাপিয়া ও মতি সুমন লোকজন নিয়ে সাংসদ নজরুলের পক্ষে মিছিল করতে করতে এলাকায় ঢুকতেন।

পৌর মেয়র কামরুজ্জামান সাংসদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে বলেন, ‘ওরা মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় আমি ওদের তাড়িয়ে দিই। সাংসদ নজরুলের সব অনুষ্ঠানেই শোডাউন করত মতি সুমন আর পাপিয়া। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাদের ব্যবহার করেছেন সাংসদ।’

জেলায় চার দশকের বেশি সময় সাংবাদিকতায় যুক্ত সরকার আদম আলী মনে করেন, সুমন-পাপিয়া ছিলেন মেয়র কামরুজ্জামান ও তাঁর ভাই লোকমানের দীর্ঘদিনের সহযোগী ও দেহরক্ষী। কাজেই কামরুজ্জামান কিছু জানেন না, এটা বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

সব জেনেও চুপ ছিল পুলিশ
নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, পুলিশের কাছে তথ্য ছিল, পাপিয়া ও মতি সুমন অস্ত্র, মাদক ও স্বর্ণের ব্যবসা করেন। পাপিয়ার ভ্যানিটি ব্যাগে সব সময় পিস্তল থাকত। স্বামী-স্ত্রী দুজনই অস্ত্র চালনায় পারদর্শী ছিলেন। পাপিয়া নিজের পাজেরো গাড়িতে করে কক্সবাজার থেকে ইয়াবা আনাতেন বলেও তথ্য রয়েছে। আর তাঁদের প্রশ্রয় দিতেন সাংসদ নজরুল ইসলাম। পুলিশের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবকিছু জানা থাকলেও রাজনৈতিক কারণেই তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

নরসিংদীর পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, পাপিয়া তাঁর কাছে একবার এসেছিলেন তাঁর স্বামীর মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে কথা বলতে। কিন্তু তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।

পরিবারও সব জানত
ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে বৈধ-অবৈধ নানা ব্যবসায় যুক্ত হয়ে এই দম্পতি খুব অল্প সময়ে ব্যাপক বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। নরসিংদীতে তাঁদের দৃশ্যমান সম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে পৌর শহরের ভাগদী মার্কেজ এলাকার একটি তিনতলা ভবন, একটি একতলা বাড়ি (টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো বলে অভিযোগ), ভাগদীর বাতেন ভূঁইয়ার মিলের পাশে একটি পাঁচতলা ভবন, ব্রাহ্মণদীতে একটি ছয়তলা ভবন। এ ছাড়া ভাগদী এলাকার ২ নম্বর ব্রিজের সামনে বেলদী সড়কে ১০ শতাংশ জায়গায় কেএমসির নতুন শাখার কাজ চলছে।

মতি সুমনের বাবার নাম মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি নরসিংদীর একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান। মতি সুমনের ব্রাহ্মণদীর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁদের চারতলা ভবন তৈরির কাজ চলছে। মতি সুমনদের ফ্ল্যাটে চলছে অন্দরসজ্জার কাজ। তাঁর মা-বাবা বর্তমানে ছোট ছেলের ঢাকার বাসায় আছেন।

পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরীর বাড়ি।
পাপিয়ার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরীর বাড়ি।

শহরের ভাগদীতে পাপিয়ার বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় নতুন দোতলা ভবন। নতুন সব আসবাবে ঘর ভরা। পাপিয়ার বাবা, বোনসহ সবার জীবনযাত্রা হঠাৎ পাল্টে গেছে। পাপিয়ার বাবা সাইফুল বারী আগে পেট্রোবাংলার গাড়ি চালাতেন। তিনি বলেন, ঢাকায় গাড়ির ব্যবসা করতে গিয়ে পাপিয়ার অধঃপতন হয়েছে। পাপিয়ার বোন লায়লা আক্তার বলেন, সাংসদ নজরুল সব রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে পাপিয়াকে ডাকতেন। অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে পাপিয়ার ভালো যোগাযোগ ছিল। এখন সবাই না-চেনার ভান করছেন। এটা খুবই হাস্যকর।

লায়লা বলেন, তিনিও বোনের সঙ্গে অনেকবার ওয়েস্টিন হোটেলে গিয়েছেন, সাঁতার কেটেছেন। তাঁর দাবি, পাপিয়া অন্য ব্যবসা করেন। গণমাধ্যমে তাঁকে যেসব অবৈধ কর্মের সঙ্গে যুক্ত বলা হচ্ছে, তিনি সেসবের সঙ্গে ছিলেন না। হোটেলের ওই স্যুটে যেসব মেয়ে থাকতেন, তাঁরা পাপিয়ার সঙ্গে সব জায়গায় যেতেন। পাপিয়ার বোনের দাবি, ‘মতি সুমন যা বলেন, পাপিয়া তা-ই করত। কিন্তু সবখানেই আসছে আমার বোনের নাম। এটা অন্যায়।’