৫% বস্তিবাসী ভালো খাবার পায়

কল্যাণপুর পোড়া বস্তি l প্রথম আলো ফাইল ছবি
কল্যাণপুর পোড়া বস্তি l প্রথম আলো ফাইল ছবি

একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে রাজধানীর বস্তিবাসীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাদের মোট আয়ের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয় খাবার কেনা বাবদ। মাত্র ৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষ তিন বেলা পুষ্টিকর খাবার পায়। 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ও বস্তিবাসীদের সংগঠন ঢাকা নর্থ কমিউনিটি টাউন ফেডারেশনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী খাদ্যনিরাপত্তা–বিষয়ক ওই গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল ৪ মার্চ চূড়ান্ত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শহরের বস্তিবাসীর সবচেয়ে দরিদ্ররা দিনে মাথাপিছু ৩৩ টাকা ও সবচেয়ে সচ্ছল ব্যক্তিরা মাথাপিছু ১৩০ টাকা খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বস্তিবাসীর আয়ের বড় অংশ ঘরভাড়া বাবদ চলে যায়। তাই তাদের জন্য আমরা স্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি, থাকার জায়গার স্থায়ী ব্যবস্থা হলে তাদের খাদ্য পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।’

২০১৯ সালের বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসতি এলাকা মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধ, দুয়ারিপাড়া, কড়াইল, আগারগাঁও ও সাততলা বস্তি এলাকায় জরিপটি করা হয়েছে। এসব এলাকার পরিবারগুলোর খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ, ব্যয় ও মানের বিষয়গুলো গবেষণায় এসেছে।

এ ব্যাপারে গবেষণাটির প্রধান কারিগরি পরামর্শক জন টেলর প্রথম আলোকে বলেন, ‘শহরের দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, তা খুঁজে বের করতেই গবেষণাটি করা হয়েছে। তাদের নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব, তা জানার চেষ্টা করেছি।’

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বস্তিবাসীর ১০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ তিন বেলা খাবার পায় না। তারা মূলত দুই বেলা খাবার পায়। খাবারের মধ্যে থাকে ভাত, আলু ভর্তা ও ডাল। এসব খাবার খেয়ে তাদের ঠিকমতো পেট ভরে না। বাজার থেকে সস্তা শাকসবজি ও শুকনো মাছ কিনে থাকে। মূলত স্থানীয় বাজার থেকে ও সবাই কিনে নেওয়ার পর উচ্ছিষ্ট হিসেবে থেকে যাওয়া কম দামি খাবারগুলো তারা কিনে থাকে।

৮৫ শতাংশ বস্তিবাসী তিন বেলা খাবার পায়। তবে ওই খাবারের বেশির ভাগ অংশ থাকে ভাত। ভাতের সঙ্গে অবশ্য সামান্য শাকসবজি, ডাল, মাছ ও মুরগি থাকে। তবে মুরগির মাংস ও মাছ থাকে মাসে বড়জোর দুবার। প্রতি বেলা খাবারের সঙ্গে দু–একটির বেশি তরকারি তারা খেতে পায় না। তবে ওই খাবার খেয়ে তাদের পেট ভরে। কিন্তু তাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান কম থাকে। ফলে তারা অপুষ্টির শিকার হয়।

মাত্র ৫ শতাংশ পরিবার তিন বেলা পেট ভরে ভাত, ডাল ও শাকসবজি খায়। প্রতি সপ্তাহে তারা মাছ ও মুরগিও খেয়ে থাকে। পরিবারের সব সদস্যের জন্য প্রয়োজনীয় ফলমূলও তারা পেয়ে থাকে। এসব পরিবার তাদের জন্য সব ধরনের পুষ্টি পেয়ে থাকে। আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকায় তারা এসব খাবার কিনে খেতে পারছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

দরিদ্র পরিবারগুলো প্রয়োজনীয় খাবার না পাওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তারা অনিয়মিত আয়ের ওপরে নির্ভরশীল। মূলত তৈরি পোশাক কারখানা, হকার, দিনমজুর ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভর করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। তবে এসব পরিবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেলে বা পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে খরচ বেড়ে যায়। ওই খরচের চাপ সামলাতে গিয়ে তাদের খাদ্য কেনার বাজেটে টান পড়ে। দরিদ্র পরিবারগুলো খাবারের গুণগত মান কেমন বা পুষ্টিকর কি না, সেটার ওপর কম গুরুত্ব দেয়। তারা মূলত পেট ভরে খাওয়াকে খাদ্যনিরাপত্তা মনে করছে।

এই পরিস্থিতিতে গর্ভবতী নারী, মায়ের দুধ পান করে এমন শিশু এবং বৃদ্ধরা পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ায় তাদের শারীরিক বৃদ্ধি কম হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তাদের নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। শহরের দরিদ্র পরিবারগুলোর আয়ের বড় অংশ অবশ্য ব্যয় হচ্ছে ঘরভাড়া, পানি জোগাড় করা ও কেনা, মোবাইল ফোনের বিল ও অন্যান্য সেবা সংগ্রহ করতে গিয়ে।

শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বস্তি এলাকাগুলোর বাড়ির টিনের চালায় ও ফাঁকা স্থানে যতটুকু সম্ভব সবজি চাষ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এর আগের বিভিন্ন গবেষণাতেও শহরের দরিদ্রের পুষ্টিনিরাপত্তার ক্ষেত্রে একই চিত্র পাওয়া গেছে। শহরের দরিদ্রদের বাসস্থান থেকে শুরু করে সবকিছু কিনে নিতে হয়। ফলে তাদের আয়ের বড় অংশ এসব খাতে চলে যায়। ফলে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বাড়ানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে তারা কী ধরনের খাবার খাচ্ছে, অর্থাৎ তা কতটুকু নিরাপদ, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।