অত্যাচারী উলকি বাহিনী, ভয়ে মুখ খুলত না কেউ

শামীমা নূর ওরফে পাপিয়া।
শামীমা নূর ওরফে পাপিয়া।

নরসিংদীতে গেলে পাশ্চাত্যের ঢঙে গায়ে উলকি আঁকা কিছু তরুণের দেখা মিলতে পারে। এঁরা ইংরেজি হরফে নিজের শরীরে ‘কেএমসি’ লিখেছেন। তবে ইদানীং তাঁরা শরীরের উলকি ঢেকে চলাফেরা করছেন।

উলকি আঁকা এসব তরুণ নরসিংদী শহরের অনেকের কাছেই মূর্তিমান আতঙ্ক। ‘কেএমসি গ্রুপ’ হিসেবে তাঁদের পরিচিতি। এঁদের কাজ ব্যবসায়ী অথবা সাধারণ মানুষকে ধরে এনে অথবা ফোন করে ডেকে নিয়ে টাকা আদায়, জমি দখল, চাঁদাবাজি। এঁরা নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতেন একটি একতলা বাড়ি। এই বাহিনী চালাতেন জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর ওরফে পাপিয়া এবং তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে মতি সুমন।

কেএমসি মানে ‘খাজা মইনুদ্দীন চিশতি’। উপমহাদেশের প্রখ্যাত আউলিয়ার নামে অপরাধী চক্রের নাম রাখার সমালোচনাও করছেন অনেকে। পাপিয়ার স্বজনেরা জানালেন, সুমন–পাপিয়া দম্পতি প্রতিবছর ভারতের আজমিরে খাজা মইনুদ্দীনের দরগাহে যেতেন। তাঁরা বিভিন্ন জনকে বলেছেন, খাজা মইনুদ্দীন চিশতির দরগাহে গিয়ে তাঁদের ভাগ্য ফিরেছে। তাই বাহিনীর নাম দিয়েছেন কেএমসি।

পাপিয়ার বোন লায়লা আক্তার বলেন, পাপিয়া–সুমন প্রতি রোজায় আজমিরে গিয়ে সেহ্রির আয়োজন করতেন। ‘ডেক চড়াতেন’ বা সবাইকে খাওয়ানোর খরচ দিতেন। পাপিয়াকে খুশি করতেই বাহিনীর সবার শরীরে কেএমসির উলকি আঁকা হতো। গত বছর পাপিয়া এলাকায় উলকি আঁকার জন্য একজন লোক নিয়ে যান। পরে বাহিনীর সবাইকে ডেকে এনে উলকি আঁকানো হয়।

পাপিয়া ও তাঁর স্বামী সুমনের হাতেও কেএমসির উলকি আঁকা রয়েছে। পাপিয়ার এক হাতে ধর্মীয় স্থাপনার ছবি আর অন্য হাতে নারী মূর্তির উলকিও রয়েছে। একই রকম ট্যাটু রয়েছে সুমনের হাতেও। ভাগদী এলাকায় ট্যাটু আঁকা রয়েছে পাপিয়ার ভাই সাব্বির আহমেদ ও সোহাগ আহমেদ, বোন লায়লা আক্তার ও এক ভাইয়ের স্ত্রীর হাতেও। উলকি আঁকা আছে কেএমসির এমন সদস্য অনিককে ছয় মাস আগে কক্সবাজারের টেকনাফে ১২ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

কেএমসি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার নরসিংদী শহরের দাসপাড়ার রাজমিস্ত্রি রোয়েল দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ২১ ফেব্রুয়ারি কেএমসি গ্রুপের ১০-১৫ জন বাড়িতে এসে প্রথমে তাঁর ঘরবাড়িতে ভাঙচুর করে। এরপর তাঁকে মারতে মারতে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা তাঁর মোবাইল নিয়ে নেয় এবং দুই লাখ টাকা চাঁদা চায়। না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। রোয়েলের দাবি, এলাকার চেয়ারম্যান ও স্থানীয় লোকজন এ ঘটনা দেখলেও কেউ কিছু বলেনি। পরে পরিবারের লোকজন এসে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশের কাছে কয়েকবার যাওয়ার পরও মামলা নেয়নি। এসব কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন রোয়েল।

নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে কেউ চাঁদা চায়? এ প্রশ্নের জবাবে রোয়েল বলেন, কেএমসি বাহিনী ধনী-গরিব দেখে না। তাদের ভয়ে কেউ কিছু বলে না, তাই তারা যাকে ইচ্ছা তার ওপরই চড়াও হয়।

নরসিংদী শহরের ভাগদী, ব্রাহ্মণদী, দত্তপাড়া, দাসাইল, দক্ষিণ কান্দাপাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, এই বাহিনীর সদস্যসংখ্যা দুই শতাধিক। নরসিংদীর স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে কেএমসি বাহিনী ও তাদের উলকি খুবই পরিচিত। ভয়ে এদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলে না।

উলকি আঁকা ১০ জনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। দাসপাড়ার আবদুর রউফ রাব্বির হাতে বড় করে আঁকা কেএমসি। তিনি বলেন, তিনি দ্রুত বিয়ে করায় ছাত্রলীগের কোনো পদ পাচ্ছিলেন না। হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। পরে একদিন পাপিয়া ও সুমন তাঁকে ডেকে নিয়ে কেএমসি গ্রুপে যোগ দিতে বলেন। ছাত্রলীগের পদ পাইয়ে দেওয়ারও আশ্বাস দেন। এরপর থেকে তিনি কেএমসির সদস্য। পাপিয়া ও সুমন নরসিংদী এলেই ডাক পড়ে তাঁর। তাঁদের কাজ হচ্ছে পাপিয়া–সুমনকে নিরাপত্তা দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া।

জানা গেল, কেএমসি বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য তরুণ, বয়স ১৮ থেকে ২৫–এর মধ্যে। অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ছাড়াও পাপিয়া–সুমনের ডাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা–সমাবেশেও যোগ দিতেন তাঁরা। কেএমসির সদস্যদের বিনা মূল্যে ইয়াবা দেওয়া হতো। কয়েকজনকে মোটরসাইকেল দেওয়া হয়েছে।

কেএমসির আরেক সদস্য রুমির সঙ্গে কথা হয় ঢাকার নাখালপাড়ায়। তিনি জানান, পাপিয়া ও সুমনের গ্রেপ্তারের পর থেকে বেশির ভাগ সদস্য ঢাকায় পালিয়ে আছেন। রুমির মতে, সাগর ছিলেন এই গ্রুপের প্রধান সমন্বয়কারী। তাঁর সঙ্গে পাপিয়া–সুমন যোগাযোগ করতেন। আর নরসিংদীতে সাগরের মাধ্যমে অনেক নির্দেশনা পেতেন তাঁরা। আবার কার কাছে চাঁদা নিতে যেতে হবে, কাকে মারতে বা ধরে আনা হবে, এসব নির্দেশনা আসত সরাসরি সুমনের কাছ থেকে। পাপিয়ার ভাইবোনেরাও এসবের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের বাড়িতেই বেশির ভাগ দিন বৈঠক হতো।

কেএমসির সদস্যরা জানান, তাঁদের নিয়মিত টাকা দেওয়া হতো না। জমি দখল বা চাঁদাবাজিতে যাঁরা যুক্ত থাকতেন, তাঁরা সেই টাকা থেকে ভাগ পেতেন। তবে প্রয়োজনে পাপিয়া ও সুমনের কাছে টাকা চাইলে পাওয়া যেত। জেলায় কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড অটো সলিউশন নামে তাঁদের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানকার কর্মীদেরও অনেকের হাতে কেএমসির উলকি দেখা যায়।

তবে কেএমসি বাহিনীর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে পুলিশ। নরসিংদীর পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেএমসি বাহিনী বলতে কিছু নেই। এসব বানানো।’

নরসিংদীর নাট্যকর্মী হাসান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে পাপিয়া-সুমনদের দেখা গেলেও তাঁরা যে এত বড় বড় সব অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, এত দিন আমরা জানতাম না। মূলত স্থানীয় রাজনীতির বিভাজনের সুযোগ নিয়ে এঁরা তৈরি হয়েছে। এমন পাপিয়া-সুমন আর যেন তৈরি না হয়, সেদিকে রাজনীতিবিদদের খেয়াল রাখতে হবে।’