নওগাঁয় মামলা এড়াতে মীমাংসায় ঝোঁক

স্বামী হামিদুর রহমানের বিচার চেয়ে মাসের পর মাস এলাকার জনপ্রতিনিধি ও মাতবরদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন রোকসানা বেগম। অবশেষে প্রতিবেশীদের পরামর্শে গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে যান। এক মাসের মধ্যে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় দুই পক্ষ সম্প্রতি মীমাংসা চুক্তি করে। তাঁদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং স্বামী দেনমোহর ও ভরণপোষণ বাবদ ৬০ হাজার টাকা দিতে সম্মত হন।

শুধু নওগাঁ পৌরসভার বোয়ালিয়া এলাকার বাসিন্দা রোকসানা বেগম কিংবা হামিদুর রহমান নয়, তাঁদের মতো আরও অনেক বিচারপ্রার্থী অসহায় মানুষ মামলাজটের কারণে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর-অলটারনেটিভ ডিসপিউট রিসলিউশন) মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে লিগ্যাল এইড কার্যালয়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এ ছাড়া মামলা হওয়ার আগেই অনেক বিরোধ লিগ্যাল এইড কার্যালয়ের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হচ্ছে।

নওগাঁ লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা চালু হয় ২০১৭ সালে। প্রথম বছরে মামলা নিষ্পত্তি হয় ১৭টি। ২০১৮ সালে ১৩৮টি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়। ২০১৯ সালে ৪৩৭টি বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। সর্বশেষ গত দুই মাসে (চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস) ১৬২টি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১ মার্চ থেকে চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই বছরে ৭২৫টি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে এডিআরের মাধ্যমে। এই সময়ের মধ্যে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় ৪৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা আদায় করে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে দেওয়া হয়েছে। এই পদ্ধতিতে সুফলভোগীদের অধিকাংশই নারী। দুই বছরে জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয় থেকে আইনি সেবা নিয়েছেন ২ হাজার ৬৯৭ জন। সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে নারী ১ হাজার ৬১৯ ও পুরুষ ১ হাজার ৭৮ জন।

নওগাঁ জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনের নিচতলায় জেলা লিগ্যাল কার্যালয় অবস্থিত। দরিদ্র ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের বিনা মূল্যে আইনি সেবা দেওয়া হয় এখানে। জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা একজন সিনিয়র সহকারী জজ। সাধারণত কোনো ভুক্তভোগী ব্যক্তি জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে প্রতিকার পেতে গেলে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা তাঁর আবেদনটি আমলে নেন। এরপর অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে সেটি আপস-মীমাংসাযোগ্য হলে তিনি ভুক্তভোগীকে মীমাংসার পরামর্শ দেন। আবেদনকারী রাজি হলে তারপর জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয় থেকে অপর পক্ষকে হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। নির্ধারিত দিনে দুই পক্ষ হাজির হলে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা তাঁদের মধ্যে মীমাংসার চেষ্টা করেন। আপস-মীমাংসার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান হলে চুক্তি হয়। এই চুক্তি দুই পক্ষই মানতে আইনগতভাবে বাধ্য। আর যদি সমস্যাটি আপসের মাধ্যমে সমাধান করা না যায়, তখন লিগ্যাল এইড কার্যালয় থেকে ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হয়।

জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান জেলা ও দায়রা জজ এ কে এম শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লিগ্যাল এইড সংস্থার মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় খুব অল্প সময়ের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের ফলে অনেক বিরোধ মামলা হওয়ার আগেই নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে। মীমাংসাযোগ্য বিরোধের ক্ষেত্রে অভিযোগকারীদের আমরা এই পথে এগোনোর পরামর্শ দিই। এর ফলে অনেক মানুষ মামলা এড়িয়ে মীমাংসায় ঝুঁকছেন। এতে তাঁরা যেমন উপকৃত হচ্ছেন, আদালতের ওপর মামলার চাপও কমছে। আবার অনেক গরিব মানুষ রয়েছেন, যাঁদের পক্ষে মামলার ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়। লিগ্যাল এইড কার্যালয়ের মাধ্যমে তাঁদের পক্ষে প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ করে দেওয়া হচ্ছে। সরকার গরিবের অধিকার সুরক্ষায় এই উদ্যোগ চালু করেছে।’

নওগাঁ জজকোর্টের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আব্দুল খালেক বলেন, ‘১১টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এই জেলায় লোকসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। স্বাভাবিকভাবে মামলার সংখ্যাও বেশি। ৬০ হাজারের অধিক মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। এই পরিপ্রেক্ষিতে মামলাজট কমাতে আদালত ও বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’

নওগাঁ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোদাদদ খান বলেন, ‘বিচারকস্বল্পতা, বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা কারণে মামলাজট বাড়ছে। এই অবস্থায় লিগ্যাল এইড কার্যক্রম ও এডিআর পদ্ধতি জনপ্রিয় করতে হবে। সেই লক্ষ্যে বর্তমান বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে সাধারণ মানুষকে লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন করতে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি মামলাজট কমাতে আইনজীবী, পুলিশ ও বিচারকদের সঙ্গে তিনি নিয়মিত কনফারেন্স করছেন। এসব কনফারেন্সে উত্থাপিত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখছি, বর্তমানে পাঁচ বছরের অধিক পুরোনো মামলাগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি করে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। শুনানির দিনে সরকারি সাক্ষীদের হাজিরা আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে মামলা দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি হচ্ছে।’