এক ফোঁটা রাসায়নিক না কিনেও সোয়া কোটি টাকা হাওয়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানা। ছবি: প্রথম আলো
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানা। ছবি: প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানায় তরল নাইট্রোজেন কেনার নামে প্রায় সোয়া কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। কারখানার নিজস্ব তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় এক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। আর সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিসিআইসি উচ্চতর তদন্ত শুরু করেছে। তাঁরা আরও কেউ জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখবে। বিসিআইসি ১১ কর্মকর্তাকে নোটিশ দিয়েছে।

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তার নাম মেহেদি ইসলাম। তিনি আশুগঞ্জ সার কারখানা কোম্পানি লিমিটেডের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। পাশাপাশি তাঁকে কেন স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হবে না, এ মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশও দিয়েছে বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি)।

জানতে চাইলে আশুগঞ্জ সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারখানার গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিকভাবে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এবং কাগজে আর্থিক গরমিলের সত্যতা পেয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন বিসিআইসির চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে। বিসিআইসি কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চাকরি থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

সার কারখানা-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তরল নাইট্রোজেন কিনে আসছে আশুগঞ্জ সার কারখানা কর্তৃপক্ষ। জার্মান এই কোম্পানি ২০১৮ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশে কারখানা চালু করে। তাদের কাছ থেকে তরল নাইট্রোজেন কেনার কার্যক্রম সম্পন্ন করে আশুগঞ্জ কারখানার বাণিজ্যিক বিভাগের অনুবিভাগ স্থানীয় ক্রয় শাখা। এই শাখার দায়িত্বে ছিলেন সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মেহেদি ইসলাম। তিনি রাসায়নিক (তরল নাইট্রোজেন) না কিনেই লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের নামে ভুয়া রসিদ তৈরি করেন। এই রাসায়নিক কেনা হয়েছে ও কারখানায় পৌঁছেছে, তা দেখাতে তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নেন। কারখানার কয়েকজন কর্মকর্তার নকল সিলমোহর বানিয়ে স্বাক্ষর জালিয়াতি করেন মেহেদি। কারখানার হিসাব বিভাগ থেকে মেহেদি ১১টি চেক নেন। ১০টি ব্যবহার করে তিনি লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের নামে মোট ১ কোটি ২১ লাখ ৮১ হাজার ৯৩৯ টাকার বিল অনুমোদন করিয়ে নেন। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নামে চেক অনুমোদন করালেও টাকাগুলো তিনি নিজেই তুলে নিয়ে হাওয়া করে দিয়েছেন। অথচ এক ফোঁটা তরল নাইট্রোজেনও কারখানায় পৌঁছায়নি।

>

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তার নাম মেহেদি ইসলাম। তিনি কারখানার সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানা। ছবি: প্রথম আলো
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানা। ছবি: প্রথম আলো

এ জালিয়াতির বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে গত জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে। তখন কারখানার ক্রয় শাখায় লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি বিক্রয় রসিদ নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। বিষয়টি কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে রসিদটি নিয়ে লিন্ডে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চিত করে, ওই বিক্রয় রসিদ তাঁদের নয়।

জানতে চাইলে আশুগঞ্জ সার কারখানার সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মেহেদি ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমডি স্যারের অনুমতি ছাড়া আমি কিছু বলতে পারব না।’

অধিকতর তদন্তে বিসিআইসি
আশুগঞ্জ সার কারখানা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। এতে কারখানার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. কামরুজ্জামানকে প্রধান করা হয়। তাঁদের তদন্তে অভিযোগটি প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কমিটি প্রথমে প্রতিবেদন জমা দেয় ১ ফেব্রুয়ারি। তাতে অভিযুক্ত মেহেদি ইসলামের নাম লেখা হয় ‘মেহেদি হাসান’। পরে নামটি সংশোধন করে ৯ ফেব্রুয়ারি আবার তারা প্রতিবেদন জমা দেয়।

কারখানা কর্তৃপক্ষ ২ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদনটি বিসিআইসির চেয়ারম্যানের কাছে পাঠায়। বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ ১১ ফেব্রুয়ারি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তিন সদস্যের সেই কমিটির প্রধান হয়েছেন বিসিআইসির হিসাব নিয়ন্ত্রক গোলাম ফারুক। অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কমিটিকে। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, দায়িত্বে অবহেলা ও সহযোগিতার অভিযোগে কারখানার ১১ কর্মকর্তাকে নোটিশ দিয়েছে বিসিআইসি।

কারখানার নিজস্ব তদন্ত কমিটির প্রধান কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিসিআইসির তদন্ত কমিটির সদস্যরা এসেছিলেন। তাঁরা ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরেজমিনে তদন্ত করেন। তবে এখন পর্যন্ত তাঁরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেননি বলে তিনি জানতে পেরেছেন। এ তদন্তের পর মোটামুটি ধারণা পাওয়া যাবে, আসলে কীভাবে কী হয়েছিল।