ভর্তুকিতেও আবাদ বাড়ছে না

গমখেতে এক কৃষক। সোমবার যশোরের বাঘারপাড়ার কড়াইতলায়।  প্রথম আলো
গমখেতে এক কৃষক। সোমবার যশোরের বাঘারপাড়ার কড়াইতলায়। প্রথম আলো

যশোরের শার্শা উপজেলার রাঘবপুর গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম। তিনি আগে প্রতিবছরই গম চাষ করতেন। ২০১৬ সালে সাড়ে তিন বিঘা জমিতে গমের চাষ করেছিলেন, কিন্তু ব্লাস্ট রোগে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হন। পরে গমের চাষ ছেড়েই দেন। এ বছর কৃষি বিভাগ থেকে ভর্তুকির বীজ ও সার পেয়েছেন। তাই অল্প কিছু জমিতে গমের চাষ করেছেন। 

খোরশেদ তবু গম চাষে ফিরেছেন। অভয়নগর উপজেলার বগুড়াতলা গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম শেখ মুখই ফিরিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘১০ বছর গমের চাষ করেছি, কিন্তু রোগ যেন গমখেতের নিত্যসঙ্গী। ফলে গত দুই বছর আর গম চাষ করি না। আমার জমিতে শর্ষের চাষ করেছি।’

ব্লাস্ট রোগের প্রভাবে কৃষক খোরশেদ ও নজরুল শেখের মতো যশোরের বহু কৃষক গম চাষে আগ্রহ হারিয়েছেন। কৃষি বিভাগ এখন ভর্তুকি দিয়েও গমের আবাদ বাড়াতে পারছে না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের দিকে দেশে গমখেতে ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এতে বহু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ অবস্থায় গম চাষ না করার জন্য এলাকায় এলাকায় করা হয় মাইকিং। কৃষক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠান, উঠান বৈঠক, অনানুষ্ঠানিক সভা, লিফলেট বিতরণ এবং সরকারি বীজ সরবরাহ না করে যশোরে কৃষকদের গম চাষে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। ২০১৬-১৭ মৌসুমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এই গম চাষ নিরুৎসাহিতকরণ প্রচারণায় সাড়াও দিয়েছিলেন যশোরের কৃষকেরা। জেলায় ২০১৫-১৬ মৌসুমের ৪ হাজার ৪০ হেক্টর জমির গম চাষ হয়েছিল। পরে বছরে এক লাফে নেমে পরিমাণটা নেমে এসেছিল ৫৩০ হেক্টরে। ২০১৭-১৮ মৌসুমে গম চাষের কোনো লক্ষ্যমাত্রা ছিল না। সেবার জেলায় গমের আবাদ নেমে আসে মাত্র ৬৮ হেক্টর জমিতে।

এ বিষয়ে যশোর গম গবেষণাকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সালে গমে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ার পর গবেষণা শুরু হয়। মূলত বারি গম ২৬ জাতে এই রোগের আক্রমণ বেশি ছিল। বারি গম ৩৩ নামে নতুন একটি ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। আরও একটি ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন গবেষণার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চলতি মৌসুমে যশোরে কৃষক পর্যায়ে ২০টি বারি গম ৩৩ প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে। এ বছর বেশ কিছু জমিতে বারি গম ৩৩ আবাদ হয়েছে। আগামী মৌসুম থেকে কৃষক বিএডিসির (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) মাধ্যমে বীজ পেয়ে আরও বেশি জমিতে এ জাতের গমের আবাদ করতে পারবেন।

ব্লাস্ট প্রতিরোধী নতুন জাত হাতে আসায় কৃষি বিভাগ এখন গম চাষে কৃষককে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে। চলতি মৌসুমের শুরুতে কৃষি বিভাগ থেকে যশোরের শতাধিক কৃষককে গমের বীজ, সার ও খেত পরিচর্যার টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রদর্শনী প্লটের নামে এ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। আবাদে এসেছে ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত। তারপরও গম চাষে আগ্রহী হননি যশোরের কৃষকেরা।

গম গবেষকেরা বলছেন, গমের ব্লাস্ট একটি ক্ষতিকর ছত্রাকজনিত রোগ। গমের শিষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময়ে তুলনামূলক গরম ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া থাকলে এ রোগের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে এ রোগ দেখা দেয়। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যশোর সূত্র জানায়, ২০১৮-১৯ মৌসুমে জেলা গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭৫ হেক্টর, কিন্তু আবাদ হয় ১৯৩ হেক্টর জমিতে। চলতি ২০১৯-২০ মৌসুমে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার হেক্টর জমি, কিন্তু আবাদ হয়েছে মাত্র ৫৪৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪৫ হেক্টর, মনিরামপুর উপজেলায় ৫৫ হেক্টর, শার্শা উপজেলায় ১৫০ হেক্টর, ঝিকরগাছা উপজেলায় ৫০ হেক্টর, চৌগাছা উপজেলায় ১৯০ হেক্টর, অভয়নগর উপজেলায় ৫ হেক্টর, বাঘারপাড়া উপজেলায় ৪০ হেক্টর ও কেশবপুর উপজেলায় ১০ হেক্টর। এবার জেলার অল্প কিছু গমখেত ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক  আখতারুজ্জামান বলেন, গমখেতে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ার পরে কৃষকেরা অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেন। ফলে গমের আবাদ একেবারেই কমে যায়। ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের বীজ কৃষক পর্যায়ে এসেছে। কৃষকদের প্রদর্শনী প্লট দেওয়া হয়েছে। ফলে ধীরে ধীরে জেলায় গমের চাষ বাড়বে বলে তাঁরা আশাবাদী। এবার খুব অল্প জমিতে সামান্য ব্লাস্ট দেখা দিয়েছিল। সেটা নিরাময় হয়েছে। গমের ফলন ভালো হয়েছে।