বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাসের জরিপ নেই, তবু দরপত্র

বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগামী সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু সমুদ্রভাগের কোথায় তেল-গ্যাসের মতো খনিজ সম্পদের কী ধরনের সম্ভাবনা আছে, তার জরিপ হয়নি, সরকারের হাতেও কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। এমন অবস্থায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দর-কষাকষিতে সরকার কতটা সুবিধা নিতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

শর্ত সাপেক্ষে গ্যাস রপ্তানির বিধান রেখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি বা প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) অনুমোদন করে। নতুন পিএসসি অনুযায়ী, বিদেশি কোম্পানিগুলো আগের তুলনায় বেশি দামে সরকারের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে পারবে।উত্তোলিত গ্যাসের ভাগও বেশি পাবে কোম্পানিগুলো। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এ মাসে দরপত্র আহ্বানের তারিখ ঘোষণা হতে পারে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ জ্বালানি সহকারী অধ্যাপক ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সাগরভাগের খনিজ সম্পদের কোনো জরিপ নেই। এ রকম অবস্থায় চুক্তি হলে তা বাংলাদেশ ও বিদেশি কোম্পানি কারও জন্যই সুবিধার নয়। সরকারের হাতে জরিপের তথ্য থাকলে দর-কষাকষিতে ভালো অবস্থায় থাকা যেত। আবার বিদেশি কোম্পানিও বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বুঝেশুনে করতে পারত। সবার আগে দরকার সাগরে একটি বিস্তারিত জরিপ।’

মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সমুদ্র এলাকা নিষ্পত্তির পর বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়টি জোরেশোরে সামনে আসে। ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের বিষয়টি সুরাহা হয়। এতে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের টেরিটরিয়াল সমুদ্রসহ বড় একটি অঞ্চলের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিন্তু সমুদ্রজয়ের সাত বছরের মধ্যেও সমুদ্রের তলদেশে খনিজ সম্পদের কী ধরনের সম্ভাবনা আছে, তার জরিপ করতে পারেনি সরকার। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০১৩ সাল থেকে সাগরে জরিপ করার চেষ্টা চলছে। এ জন্য দরপত্রও আহ্বান করা হয়। দরপত্রের শর্ত ছিল, জরিপের জন্য বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশের কাছ থেকে কোনো অর্থ নিতে পারবে না।জরিপের তথ্য তারা আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে জরিপে ব্যয় করা অর্থ তুলে নেবে। বেশ কিছু বিদেশি কোম্পানির আগ্রহ থাকলেও ওই জরিপ করা যায়নি।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা আরও বলেছেন, জরিপের তথ্য থাকলে বাংলাদেশ নিজেই ঠিকাদার নিয়োগ করে গ্যাস উত্তোলন করতে পারে। এতে দেশের গ্যাসের মালিকানায় কেউ ভাগ বসাতে পারবে না। এ জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে (জিডিএফ) ১৮ হাজার কোটি টাকা জমা পড়েছে।

এত দিনে সাগরে জরিপ না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার এ জরিপ করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের টিজিএস-স্লামবার্জার নামে একটি কোম্পানিও মনোনীত হয়েছে।’

নতুন পিএসসির বিষয়ে নসরুল হামিদ বলেন, এবারের পিএসসি অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ। এতে উভয় পক্ষই লাভবান হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় বর্তমানে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বিনিয়োগ করতে চাইছে না বিদেশিরা। এ রকম পরিস্থিতি মাথায় রেখে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা অনেক চ্যালেঞ্জিং।

নতুন পিএসসিতে বিদেশিদের জন্য সুবিধা

২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুমোদন দেওয়া পিএসসিতে শর্ত সাপেক্ষে গ্যাস রপ্তানির বিধান ছিল। এটি ব্যাপক সমালোচিত হওয়ায় ২০১২ সালে পিএসসিতে গ্যাস রপ্তানির বিধান বাদ দেওয়া হয়।

এবারের পিএসসিতে গ্যাস রপ্তানি সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিদেশি কোম্পানি প্রথমে পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাস কেনার প্রস্তাব দেবে। ছয় মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত না জানালে ওই কোম্পানি দেশের ভেতর তৃতীয় পক্ষ বা বিদেশে গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে। এ ছাড়া উত্তোলিত গ্যাস এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) মাধ্যমে রপ্তানি করে যৌক্তিক ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারলে ওই কোম্পানিকে পেট্রোবাংলা গ্যাস রপ্তানিতে বাধা দিতে পারবে না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শর্ত পিএসসিতে অস্পষ্টতা তৈরি করেছে। চুক্তির এই অংশের ফাঁকফোকরে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ তৈরি হতে পারে।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী,দেশে এই মুহূর্তে সাগরে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার ক্ষমতা রয়েছে। এর বাইরে একটি স্থলভাগের এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বর্তমানে দিনে ৬০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে সরকারের বছরে কেন্দ্র ভাড়াসহ ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে সাগরে গ্যাস পাওয়া গেলে এক দিকে টার্মিনালগুলোর কেন্দ্র ভাড়া, অন্য দিকে সাগরের তলদেশে পাইপলাইন স্থাপন করে স্থলভাগে গ্যাস আনা লাভজনক হবে না বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এ অবস্থায় রপ্তানির পক্ষে যুক্তি তৈরি হবে। এ কারণে শর্ত সাপেক্ষেও গ্যাস রপ্তানির বিধান রাখা উচিত নয়।

নতুন পিএসসিতে বলা হয়েছে, বিনিয়োগ উঠে না আসা পর্যন্ত অগভীর সমুদ্রের উত্তোলিত গ্যাসের ৫৫ শতাংশ এবং গভীর সমুদ্রের ৭০ শতাংশ গ্যাস (কস্ট রিকভারি) পাবে বিদেশি কোম্পানি। বাকি ৪৫ ও ৩০ শতাংশ গ্যাস লাভ হিসেবে পেট্রোবাংলা ও বিদেশি কোম্পানির মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ভাগাভাগি হবে। তবে পেট্রোবাংলা মোট গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি পাবে না। যদি পেট্রোবাংলা নিজ খরচে পাইপলাইন স্থাপন করে, তাহলে গ্যাস উত্তোলনের ১১ বছর পর মোট গ্যাসের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পাবে সংস্থাটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর অর্থ হলো, সাগরের কোনো ব্লকে গ্যাস পেলে সেখানকার মজুতের ২০ শতাংশের মালিকানা থাকবে পেট্রোবাংলার হাতে, বাকিটার মালিকানা থাকবে বিদেশি কোম্পানির কাছে।

গত পিএসসিতে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ছিল ৬ দশমিক ৫ ডলার। এবার তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ ডলার করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবছর দেড় শতাংশ হারে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সুযোগও রাখা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন পিএসসিতে গ্যাসের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মূল্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। প্রতি মেট্রিক টন তেলের দাম ২১৫ ডলারের বেশি হলে বাড়তি দাম ধরা হবে না। আর তেলের দাম প্রতি টন ১৮০ ডলারের কম হলে সেই দামও ধরা হবে না। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গেলে সেটির সুফল বাংলাদেশ পাবে না।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে, সেখানে শর্ত সাপেক্ষে গ্যাস রপ্তানির বিধান রাখা খারাপ ইঙ্গিত। কারণ, দেশের আমলাতন্ত্র পারে না, এমন কিছু নেই। গ্যাস রপ্তানির জন্য যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, সেসব রাতারাতি পূরণ হয়ে যাবে, অন্তত জ্বালানি খাতে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে।

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞের মতে, এবারের পিএসসি বিদেশি কোম্পানির জন্য অনেক সুবিধাজনক হলেও তারা যে দরপত্রে অংশ নেবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। একই সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের দর-কষাকষিরও তেমন সুযোগ নেই। কারণ, পেট্রোবাংলার কাছে সাগরের ব্লকগুলোতে কী ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে, তার কোনো তথ্য নেই।