আদালতে যা বললেন ওই নারী

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার নলচক গ্রামে একটি হত্যার ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন এক নারী। প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আদায়, শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ও মুঠোফোনে বারবার বিরক্ত করার কারণে হত্যাকাণ্ড ঘটান বলে আদালতে জবানবন্দি দেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, এতে তাঁকে সহায়তা করেন দ্বিতীয় স্বামী।

গতকাল সোমবার বিকেলে কুমিল্লার বিচারিক আদালতে ওই হত্যা মামলায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে দোন ওই নারী।

১২ মার্চ রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার নলচক গ্রামে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম নুরুল ইসলাম (৪০)। তিনি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বলদীপাড়া গ্রামের রিকশাভ্যানচালক ছিলেন।

গত রোববার বেলা তিনটায় মুঠোফোন ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে দাউদকান্দির নলচক গ্রাম থেকে দাউদকান্দি মডেল থানার পুলিশ ওই নারীকে গ্রেপ্তার করে। হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর দ্বিতীয় স্বামীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

দাউদকান্দি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, গতকাল বিকেলে ওই নারীকে কুমিল্লার বিচারিক আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

গ্রেপ্তার করা নারীর (৩১) বাবার বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার একটি গ্রামে।

আদালত সূত্রের বরাত দিয়ে ওসি জানান, আদালতে ওই নারী রিকশাভ্যানচালক নুরুল ইসলামকে হত্যার কথা স্বীকার করে বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা আদায়, পরে আবার টাকা আদায়ের চেষ্টা, দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং মুঠোফোনে বারবার বিরক্ত করার জন্যই তাঁকে হত্যা করেন তিনি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ওই নারী ২০০৭ সালে বাগমারার একটি কারিগরি স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ২০০৯ সালে একটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। স্কুলে পড়ার সময়ে একই এলাকার সহপাঠীর সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে দুজনে বিয়ে করেন। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামী অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। এমন পরিস্থিতিতে ওই নারী ২০১২ সালে একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) চাকরি নেন। তবে কিছুদিন পর তাঁর চাকরি চলে যায়।

২০১৬ সালে ওই সংস্থায় আবার নিয়োগ পান তিনি। ২০১৭ সালে তাঁকে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় বদলি করা হয়। সেখানে চাকরির সুবাদে রিকশাভ্যানচালক নুরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয়। নুরুল রিকশাভ্যান চালানোর পাশাপাশি কবিরাজি করতেন। ওই নারীর কাছে তাঁর স্বামীর কথা শুনে নুরুল ইসলাম তাঁকে ‘কবিরাজি মন্ত্র-তন্ত্রের মাধ্যমে’ তাঁর কাছে ফিরিয়ে আনতে পারবেন বলে আশ্বস্ত করেন। এ জন্য তাঁর কাছে খরচ বাবদ ৫০ হাজার টাকা নেন নুরুল। একসময় কৌশলে ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও গড়ে তোলেন। এরপর বারবারই তাঁর কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করেন।

গত বছর ওই নারীকে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের নলচক গ্রামে বদলি করা হয়। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও ফিরে স্বামীকে না পেয়ে গত বছর মনোমালিন্যের একপর্যায়ে তিনি তাঁকে তালাক দেন। পরে চাকরির সুবাদে পরিচিত সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার এক কৃষিজীবী যুবককে মুঠোফোনে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে দ্বিতীয় স্বামী তাঁর কাছে দাউদকান্দি যাতায়াত করতেন। ১০ মার্চ দ্বিতীয় স্বামী তাঁর কাছে আসার পর নুরুল ইসলাম মুঠোফোনে তাঁকে কল দেন। স্বামী উপস্থিত থাকায় তিনি কলটি কেটে দেন। এরপরও বারবার নুরুল কল দিতে থাকলে একসময় তিনি কলটি রিসিভ করে কথা বলেন। নুরুল ওই সময় ফোনে তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

ফোনের আলাপচারিতা থেকে দ্বিতীয় স্বামী তাঁকে সন্দেহ করলে তিনি তাঁকে সবকিছু খুলে বলেন। পরদিন নুরুল ইসলাম আবারও ওই নারীর মুঠোফোনে কল করলে তিনি তাঁকে ১২ মার্চ দাউদকান্দি আসার অনুরোধ করেন এবং স্বামীর সঙ্গে মিলে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

নুরুল ইসলাম ওই রাতে দাউদকান্দির শ্রী রায়েরচর এলাকার একটি মাজারের কাছে পৌঁছালে ওই নারী তাঁকে সেখান থেকে নলচক গ্রামের একটি ভুট্টাখেতে নিয়ে যান। পরিকল্পনা অনুসারে সেখানে আগেই ঘাপটি মেরে ছিলেন দ্বিতীয় স্বামী। ভুট্টাখেতে নুরুল ইসলাম ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে উদ্যত হলে লুকিয়ে থাকা দ্বিতীয় স্বামী লোহার রড দিয়ে নুরুলের মাথায় আঘাত করেন। আঘাতে নুরুল মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন ওই নারী।

১৩ মার্চ নলচক গ্রামের একটি ভুট্টাখেতে নুরুল ইসলামের লাশ দেখে এলাকাবাসী পুলিশকে খবর দেন। খবর পেয়ে থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দাউদকান্দি মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুজন দত্ত বলেন, তদন্তের পর হত্যার সঙ্গে ওই নারী জড়িত থাকার বিষয়টি নজরে আসে। গ্রেপ্তারের পর ওই নারীর দেওয়া তথ্য অনুসারে ঘটনাস্থল থেকে লোহার রডটি উদ্ধার করা হয়। ওই নারীর দ্বিতীয় স্বামীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।