করোনাভাইরাস: লঞ্চে প্রতিদিন লাখো যাত্রীর ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল

লঞ্চে যাত্রীদের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল। প্রথম আলো ফাইল ছবি
লঞ্চে যাত্রীদের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল। প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই জনসাধারণের চলাচল ও হাসপাতালগুলোয় বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। সংক্রমণ ঠেকাতে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে রাখতে শুরু হয়েছে তৎপরতা। কিন্তু বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে প্রতিদিন লাখো মানুষ ঝুঁকি নিয়ে অবাধে চলাচল করায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নৌপথনির্ভর দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলার ৩৮টি নৌপথে প্রায় দেড় শ দোতলা-তিনতলা লঞ্চ চলাচল করে। এসব লঞ্চের একেকটির ডেকে (লঞ্চের আকারভেদে) প্রতিদিন গাদাগাদি করে গন্তব্যে ছুটছেন অন্তত এক থেকে দেড় হাজার যাত্রী। দিনে ১৫ লাখের বেশি যাত্রী এসব নৌপথে যাতায়াত করেন। কিন্তু ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি একেবারে উপেক্ষিত থাকায় শঙ্কা বাড়ছে।

যাত্রীরা বলছেন, তাঁরা বাধ্য হয়ে এসব পথে গাদাগাদি ও ঠাসাঠাসি করে করে লঞ্চে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টার যাত্রা করেন। লঞ্চগুলোর ডেকে প্রতিনিয়ত যাত্রীদের এতটা ভিড় থাকে যে একজন যাত্রীর নিশ্বাস আরেকজনের শরীরে লাগে। এই পরিস্থিতিতে যদি কোনোভাবে করোনাভাইরাস বহনকারী কেউ লঞ্চের যাত্রী হন, তাহলে দ্রুত অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আছে।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আজ বৃহস্পতিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৬৬টি দেশ ও অঞ্চলে ২ লাখ ৭ হাজার ৮৬০ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত। মারা গেছেন ৮৬৫৭ জন।

লঞ্চ মালিক সমিতি সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে দেশের অন্তত ৬০টি পথে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি লঞ্চ চলাচল করে। প্রতিটি লঞ্চ কমপক্ষে দুই থেকে তিন হাজার যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। এসব লঞ্চে দৈনিক যাতায়াত করে ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র বলছে, নৌপথে প্রতিদিন কয়েক লাখ যাত্রী যাতায়াত করছেন। আপাতত যাত্রীদের সচেতন করা ছাড়া কার্যত আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার উপায় নেই।

১৬ মার্চ বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তার ও ট্রাফিক বিভাগের ঢাকা সদর দপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোকে ছয় দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—ডেক, কেবিন পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য যাত্রী তোলার আগে জীবাণুনাশক স্প্রে করা। যাত্রীদের লঞ্চে তোলার সময় হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করে দেওয়া। লঞ্চের শৌচাগারগুলোকে পরিচ্ছন্ন এবং সেখানে পর্যাপ্ত পানি ও সাবানের ব্যবস্থা রাখা। যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা। বিদেশফেরত যাত্রীদের অন্য যাত্রীদের থেকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা। করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্কতা বিষয়ে লঞ্চে মাইকিং, টেলিভিশনে করোনাভাইরাস সম্পর্কে যাত্রীদের সচেতনতামূলক প্রচার ও স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা প্রচার করা।

বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল অঞ্চলের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপপরিচালক আজমল হুদা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এরই মধ্যে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে নৌযান মালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা যাতে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ মেনে চলে, এ জন্য বন্দরে নজর রাখা হচ্ছে।

যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চগুলো নির্দেশনা মেনে চলছে না। আগের মতোই সবকিছু চলছে। শৌচাগারগুলো অপরিচ্ছন্ন, পর্যাপ্ত সাবান নেই। ডেকে পরিচ্ছন্ন এবং জীবাণুনাশক স্প্রে দেওয়ার কথা থাকলেও সে নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। ডেক যাত্রীদের জন্য শৌচাগারগুলোর খুবই নোংরা। সেখানে সাবান তো দূরের কথা পর্যাপ্ত পানিরও ব্যবস্থা নেই। গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে বরিশালে এসেছেন ব্যবসায়ী সগির হোসেন। তিনি বলেন, ‘কেবিনের শৌচাগারে কোনো রকম সাবান আছে। তবে দুর্গন্ধ ও অপরিচ্ছন্ন। ডেকে যাত্রীতে ঠাসা। লঞ্চে ওঠার সময় হ্যান্ড স্প্রে দেওয়া হয়নি। সবকিছু আগের মতোই চলছে।’

বেশ কয়েকজন যাত্রী বলেন, ‘লঞ্চে ডেক যাত্রীদের অবস্থা আরও করুণ। যারা লঞ্চে ভ্রমণ করেন, তাঁরা সবাই জানেন যে, ডেকে ভ্রমণ করা হাজার হাজার মানুষকে গায়ে গায়ে মিশে চাদর বিছিয়ে ঘুমোতে হয়। যদি কোনো একজন করোনাভাইরাস সংক্রমিত লোক ওঠে তাহলে পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’

লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা এবং সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক সাইদুর রহমান বলেন, ‘কেবল বরিশাল বিভাগের ৩৮টি নৌপথে প্রতিদিন শতাধিক তিনতলা লঞ্চ ঢাকায় চলাচল করে। এসব লঞ্চে যাত্রীসংখ্যা ২ লাখের বেশি। আমরা সব সময় চেষ্টা করি লঞ্চগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে। কিন্তু এত যাত্রীরা একসঙ্গে লঞ্চে ওঠার পর তা আর পরিচ্ছন্ন রাখা অসম্ভব। তারপরও করোনা পরিস্থিতির কারণে আমরা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করেছি। লঞ্চগুলোকে পরিচ্ছন্ন রাখাসহ লঞ্চে কর্মরতদের নানাভাবে সতর্ক করা হয়েছে। তবে এতে কতটুকু ফল পাওয়া যাবে সেটাই বুঝতে পারছি না।’

এ বিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, সবাইকে জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং সাবধান থাকতে হবে। বিআইডব্লিউটিএ যে নির্দেশনা জারি করেছে, সেটা যথাযথভাবে সবাইকে মানতে হবে।