করোনার দিনে বাজার সফর

বাজারের সব মানুষ মাছের বাজারে ঢুকে বসে আছে। ছবি: লেখক
বাজারের সব মানুষ মাছের বাজারে ঢুকে বসে আছে। ছবি: লেখক

একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাজারের যুবক ম্যানেজার আমার পূর্বপরিচিত বলে চোখ টিপে যা বললেন, তার মর্মার্থ হলো, নো টেনশন, স্যার। কাল আসেন। ব্যবস্থা হয়ে যাব। আমিও উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলাম, ঠিক তো? তিনি অভয়ের হাসি হেসে মাথা নাড়লেন। আশ্বস্ত হওয়া গেল। ফিরলাম বাড়ি যত কিছু পাওয়া গেল, সেগুলো সঙ্গে নিয়ে।

সামনে, পেছনে, ডানে, বাঁয়ে—যেদিকেই কান রাখুন একটাই শব্দ, করোনা। মানে করোনাভাইরাস। একুশ শতকের দানব, মানুষের শত্রু। কিন্তু পেট কি আর শত্রু–মিত্রের খোঁজ রাখে? কয়েক দিন থেকে উৎকণ্ঠিত হয়ে শুনছি, বাজার ফাঁকা। সবকিছুর দাম বেশি। বাজার যে ফাঁকা, টের পেলাম মাসের বাজার করতে গিয়ে। একটা প্রতিষ্ঠানের আউটলেটে গিয়ে শুনলাম চাল উধাও। সঙ্গে লবণ, চিনি, ডালও! হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর মাস্কের কথা নাই–বা বললাম। তারপরই ম্যানেজারের সঙ্গে ওপরের কথোপকথন।

যাহোক, শুধু চাল-ডাল-লবণে তো আর চলে না। সবজি, মাছ, মাংস সবই লাগে। অগত্যা কাঁচাবাজার যেতেই হলো সব ভয় তুচ্ছ করে। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের পরিচিত মুদি দোকানদারের অবস্থা দেখলাম মাছি মারার মতোই। বসে আছেন অনেকক্ষণ, সেটা তাঁর বিরক্ত মুখ দেখেই বোঝা গেল। তবে আমায় দেখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে সালাম দিলেন—আমি তাঁর পুরোনো খদ্দের কি না। প্রয়োজনীয় জিনিসপাতির তালিকা বানাতে বানাতে তিনি জানতে চাইলেন, করোনায় তিনি মরবেন কি না। আমি নির্দ্বিধায় বললাম, সাবধান হলে বাঁচবেন। দুঃসাহসী হলে মরবেন। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি ভয় না পেয়ে বললেন, আপনের ভয় করে না, ভাইজান? বউ–বাচ্চা আর নিজের পেটের কথা ভেবেই যে জান হাতে বাসা থেকে বাজার এসেছি, সেটা বলতে আমার খানিক বাধল। ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজের বীরত্বের কথা জাহির করলাম। তিনি হেসে ফেললেন। আমি অন্যান্য আনাজপাতি কেনার কথা বলে পালিয়ে গেলাম মাছের বাজারে।

ফরসা রঙের ইনুছ মিয়া এরপর ঝানু ব্যবসায়ীর মতো বললেন, মাছ বেচতে পারতেছি না স্যার। ছবি: লেখক
ফরসা রঙের ইনুছ মিয়া এরপর ঝানু ব্যবসায়ীর মতো বললেন, মাছ বেচতে পারতেছি না স্যার। ছবি: লেখক

অদ্ভুত ব্যাপার! বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, এত বড় বাজারটা খাঁ খাঁ করছে। কিন্তু মাছের বাজারে ঢুকেই ভুল ভাঙল। মনে হলো, বাজারের সব মানুষ মাছের বাজারে ঢুকে বসে আছে। দমে গেলাম মানুষের ঠেলাঠেলির দৃশ্য দেখে। পরিচিত মাছের দোকানদার চেঁচিয়ে বললেন, স্যার। এক্কেরে তাজা। এগিয়ে গেলাম মরা রুইকে তাজা দেখতে। মাছের বাজার মানেই সেই ঐতিহ্যবাহী দরদাম। দশ টাকা কম না বেশি, তাই নিয়ে ধস্তাধস্তি। মাছ বিক্রেতা ইনুছ মিয়া করুণ মুখ করে বললেন, এই করোনার দিনেও আপনে দরদাম করতেছেন স্যার! এইটা মানবতা হইল? যদি বাঁইচা থাকি তো পরেও দরদাম করতে পারবেন। আইজকা লন। দেখলাম, ইনুছ মিয়ার ফুল স্লিভ টি–শার্টের বুকে ইংরেজিতে লেখা, নো জাস্টিস। মনটা দমে গেল। পুরো দাম থেকে দশ টাকা কম নিলেন ইনুছ মিয়া। ফরসা রঙের ইনুছ মিয়া এরপর ঝানু ব্যবসায়ীর মতো বললেন, মাছ বেচতে পারতেছি না স্যার। মানুষের কী জানি হইছে, মাছ খাওয়া ভুইল্যা গেছেগা। গত তিন দিনে পুরা মাছ ব্যাচতে পারি নাই। আমি গিজগিজ করা মানুষ দেখিয়ে বললাম, এরা কি কিনছে? দ্যাখতে আইছে স্যার। করোনার পর যদি বাঁইচা থাহে, তাইলে ক্যামনে দরদাম করব, সেই প্র্যাকটিস করতেছে। এরপর আর কথা চলে না।

শাকের বাজার আমার ভীষণ পছন্দ। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য কোথায় যেন বলেছিলেন, চৌদ্দ শাক মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। করোনার এই দিনে শরীরে পুষ্টি দরকার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। আমি শুষনি, বথুয়া, কালকাসুন্দে, সরষে, গুলঞ্চ, পটোল বা পলতা, শেলুকা, নিম, জয়ন্তী, শালিঞ্চে বা শিঞ্চে, হিলমোচিকা বা হেলেঞ্চা, ভাঁট বা ঘেঁটু, ওল, কেঁউ শাস্ত্র বর্ণিত এই চৌদ্দ শাক খুঁজতে থাকলাম। খেয়াল করলাম, এর কিছু শাকের সিজনই নেই এখন। কিছু দেশে পাওয়াই যায় না। শাক বিক্রেতা রিয়াজুল আমাকে চেনেন ভালো করে। তিনি জানান, বথুয়া, শুষনি, হেলেঞ্চা আছে তাঁর কাছে। এক আঁটি করে বেঁধে দিলেন। সঙ্গে পাটশাক। মলিন মুখে রিয়াজুল জানান, মানুষ নেই। তাই বিক্রিবাট্টাও নেই। আজ যা এনেছেন, সেগুলো বিক্রি না হলে বিপদেই পড়বেন তিনি।

তাজমহল রোডের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ‘মজা’ ৩০ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ। ছবি: লেখক
তাজমহল রোডের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ‘মজা’ ৩০ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ। ছবি: লেখক

কিচ্ছু করার নেই আমাদের। এক অদৃশ্য শত্রুর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছি আমরা। এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমাদের না আছে ঢাল, না আছে তলোয়ার। ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে কেউ কিচ্ছু জানে না। আয়ুর্বেদে লেখা চৌদ্দ শাক যদি এখন শরীরে পুষ্টি জোগায় সে ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। রিয়াজুল টাকা নিয়ে আমাকে বিদায় জানায়। এটা আমাদের পুরোনো অভ্যাস। কিন্তু আজ রিয়াজুলের মুখ মলিন। তিনি কি আমাকে চিরদিনের মতো বিদায় জানাচ্ছেন? রিয়াজুল কিংবা আমি কেউ এর উত্তর জানি না।

মনে পড়ে, আজ গ্যাস নেই আমাদের এলাকায়। কোনো ঘোষণা না দিয়েই সকাল থেকে গ্যাস ছুটি নিয়েছে। কৃষি মার্কেটের পাশেই মোহাম্মদপুর এলাকার বিখ্যাত রেস্তোরাঁ মজা। সুস্বাদু খাবার আর ‘ওপেন কিচেন’ ধারণার মাঝারি মাপের এ রেস্তোরাঁয় প্রচুর খেয়েছি, আড্ডা দিয়েছি। শাকের আঁটি হাতে মজার সামনে দাঁড়ালাম। ম্যানেজার শেখ নিদাগ জানালেন, বন্ধ। এপ্রিলের এক তারিখ রেস্টুরেন্ট খুলবে। উদ্বেগ আর অস্বস্তি নিয়ে নিদাগ আরও জানান, খবর খুব একটা সুবিধার না। জানে বাঁচবে তো মানুষজন? রেস্টুরেন্ট খোলা রাখলেও তেমন কিছু হতো না। কিন্তু এখানে কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের জানের ভার তিনি নিতে পারেন না বলে বন্ধ করে দিয়েছেন। ফিরলাম মুদি দোকানে।

সবকিছু প্যাকেট করে রেখেছেন মুদি দোকানদার। ব্যাগে ভরতে ভরতে বললেন, কিছু লাগলেই ফোন দিয়েন ভাইজান। রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাগ তুলে রওনা দিলাম বাসার দিকে।

আজ রিয়াজুলের মুখ মলিন। তিনি কি আমাকে চিরদিনের মতো বিদায় জানাচ্ছেন? রিয়াজুল কিংবা আমি কেউ এর উত্তর জানি না। ছবি: লেখক
আজ রিয়াজুলের মুখ মলিন। তিনি কি আমাকে চিরদিনের মতো বিদায় জানাচ্ছেন? রিয়াজুল কিংবা আমি কেউ এর উত্তর জানি না। ছবি: লেখক

রিকশাওয়ালার টুকটাক কথা কানে আসছে। তিনি আপনমনে কথা বলছেন আমাকে শুনিয়ে। আমি শুনছি না। রাস্তার ডিভাইডারে লাগানো অদ্ভুত বটগাছটা তারুণ্য পেরিয়ে গেল। এক মাথা কচি সবুজ পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা। পাশে দেবদারু আর মেহগনি। সবাই সবুজ কচি পাতায় সেজেছে বসন্তের কালে। আর রৌদ্রকরোজ্জ্বল এই বসন্তের দিনে পুরো পৃথিবীর মানুষের মনে নেমে এসেছে এক অদ্ভুত আঁধার। এক অদৃশ্য ভাইরাস, যাকে মানুষ ‘গোনায় ধরে না’, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অহংয়ে কঠিনভাবে পদাঘাত করেছে। পুরো পৃথিবীর অর্থনীতি, রাজনীতি, জীবনযাপন, রুটি-রুজিতে কঠিন আঘাত হেনে ঢুকে পড়েছে রান্নাঘরে। টান পড়ছে মানুষের পেটে।

মনে পড়ল, প্রায় এক যুগ আগের একটি স্মারকগ্রন্থের কথা। সঞ্জীবন শিকদার, প্রাচ্যনাটের কর্মী। আত্মহত্যা করেছিলেন বড় অকালে। তাঁর খেরো খাতায় লিখেছিলেন, ‘সামনে খাদ, পেছনে দেয়াল।/ খুব খেয়াল খুব খেয়াল।’ কেন সঞ্জীবন? আপনি কি টের পেয়েছিলেন মানুষের অহং বোধে আঘাত লাগবে অচিরেই?