শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর মারা গেছেন

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। ছবি: প্রথম আলো
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। ছবি: প্রথম আলো

মারা গেছেন শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আজ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। প্রথম আলোকে মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেন তাঁর ভাতিজা অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। মৃতুকালে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এক সন্তান রেখে গেছেন। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ছিলেন একজন শিক্ষক, গবেষক, রাজনৈতিক ও সর্বোপরি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একনিষ্ঠ নিবেদিতপ্রাণ কর্মী।

বার্ধক্যজনিত সমস্যায় দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। মূলত বাসায় থাকতেন। আজ দুপুরে চলে যান না–ফেরার দেশে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে জানান, আজ বিকেল চারটায় তাঁর মরদেহ নিয়ে চাঁদপুরের উদ্দেশে যাত্রা করবেন তাঁরা। সেখানে গুলবাহার গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে।

১৯৩৬ সালের ৯ জানুয়ারি চাঁদপুরের কচুয়া থানার গুলবাহার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। তাঁর বাবার নাম আশেক আলী খান এবং মায়ের নাম সুলতানা বেগম। তিনি ১৯৫০ সালে ঢাকা সরকারি মুসলিম হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তিনি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ১৯৫৫ সালে স্নাতক এবং ১৯৫৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্মান অর্জন করেন। সত্তরের দশকে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান এবং সেখানে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করে। পরে তিনি এই বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এই বিভাগের অধ্যাপকের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

৫০ দশকের গোড়া থেকে যে মানুষেরা সাহিত্যাঙ্গনে উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করছেন নিজের সৃজনশীল ক্ষমতা নিয়ে, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর সৃজনশীলতায় সার্বিক সাহিত্য জগৎ পরিপুষ্টতা লাভ করেছে। সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর অবদান রয়েছে কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিল্প সমালোচনা, সাহিত্য সম্পাদনা-সমালোচনার ক্ষেত্রে।

তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, উদার ও উন্নত মনমানসিকতার মানুষ। বহুগুণে গুণান্বিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর কবি পরিচয় সামনের দিকে চলে আসে। এ দেশের চিত্র, ভাস্কর্য বা এককথায় দৃশ্য শিল্পের প্রথম সারির প্রধান আলোচক তিনি। চিত্র-সমালোচনার ভিত্তি যাঁদের হাত দিয়ে গড়ে উঠেছে এবং পরবর্তী সময়ে এই বিশেষ ধারায় যাঁরা এখন পথ পরিক্রমায় সোচ্চার, তাঁদের অন্যতম পথিকৃত বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর।

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সাহিত্যজীবন শুরু হয় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে। সেই সময়ে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত নতুন কবিতা কাব্য সংকলনের সর্বকনিষ্ঠ কবি ছিলেন তিনি। এই সংকলনে অন্য কবিরা ছিলেন পঞ্চাশের অন্যতম কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান ও আলাউদ্দিন আল আজাদ। ১৯৮৩ সালে ডানা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘মাইকেলের জাগরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’। ১৯৯৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়।

সমাজতান্ত্রিক মানসমনের সমর্থক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর যেমন, তেমনি উদার মানবিকতাসম্পন্ন গণতন্ত্রী, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একনিষ্ঠ একজন বাস্তবায়ক। কবিতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বহুভাবে করে গেছেন। গভীর প্রতীকী এবং ইঙ্গিত বহনকারী মানুষ, সমাজ, দেশ, রাজনীতি তাঁর বিষয়।

তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতার মুজফফর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার এবং জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদকসহ অসংখ্য পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন। শিক্ষা ও গবেষণায় অবদানের জন্য ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন।