দুশ্চিন্তার পাশাপাশি কাতারপ্রবাসীদের স্বস্তিও আছে

বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছেন শ্রম কাউন্সেলর মুস্তাফিজুর রহমান। ছবি:প্রথম আলো
বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছেন শ্রম কাউন্সেলর মুস্তাফিজুর রহমান। ছবি:প্রথম আলো

বাংলাদেশ থেকে আবজল আহমদের কাতারে ফেরার তারিখ ছিল ১০ মার্চ। কিন্তু তার দুদিন আগে ৮ মার্চ দিবাগত রাতে বাংলাদেশ থেকে কাতারে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এ দেশের কর্তৃপক্ষ। ফলে আটকে যায় আবজলের মতো অনেক বাংলাদেশি প্রবাসীর কাতারে ফেরা।

সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের খর্দাপাড়া এলাকা থেকে আবজল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় আর কাতার ফিরতে পারিনি। কাতারে আমার ব্যবসা রয়েছে। পরিস্থিতিতে কোন দিকে মোড় নেয়, সেটি নিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তায় রয়েছি। অবশ্য কিছুদিন মা-বাবার কাছে থাকতে পারছি, এতেও ভালো লাগছে।’

বাংলাদেশ থেকে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া বা কাতারে যাত্রীবাহী ফ্লাইট আগমনের ব্যাপারে এখনো কোনো তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। এতে কিছুটা অনিশ্চিত শঙ্কায় ভুগছেন অনেক কাতারপ্রবাসী। কাতারে থাকা প্রবাসীদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ঘনঘন তাঁরা জানতে চাইছেন, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হলো কি-না।

অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরপরই কাতার কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, এ সময়ের মধ্যে যাদের কাতারি পরিচয়পত্র বা ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবে, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর তারা সবাই কোনো জরিমানা বা ফি ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে এ দেশে প্রবেশের সুযোগ পাবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের কারণে কাতারে থাকা অনেক বাংলাদেশি শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। বিভিন্ন কোম্পানিতে যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, তারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও যারা নিজ কোম্পানিতে কাজ না করে স্বাধীনভাবে কাজ করেন, তাদের দুশ্চিন্তা কিছুটা বেশি।

কাতার কর্তৃপক্ষ অবশ্য ঘোষণা করেছে, যেসব কোম্পানির শ্রমিক বিচ্ছিন্ন সানাইয়া শিল্পাঞ্চলে বর্তমানে কর্মহীন অবস্থায় আছেন, তারা মাস শেষে নিজেদের পুরো মাসের বেতন পাবেন। একটি সুপারশপে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মী সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণপরিবহন বন্ধ থাকায় যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও আমি নিয়মিত কাজে যাই।’
সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তায় ভুগছেন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার শ্রেণির বাংলাদেশি প্রবাসীরা। দোহায় রেস্তোরাঁ ও কাপড়ের দোকানসহ একাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিক শরিফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সানাইয়ায় প্লাজামলে আমার তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে এগুলো বন্ধ। কিন্তু এসবের ভাড়া, পানি ও বিদ্যুৎ বিল মওকুফ হবে কি না, সে ব্যাপারে আমরা চিন্তিত।’

দোহায় অন্যতম পুরোনো বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ স্টার অব ঢাকা হোটেলের মালিক মাহাবুব আলম বলেন, সরকারি আদেশে রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া-দাওয়া নিষিদ্ধ। ফলে ক্রেতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এই অবস্থায় অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তায় থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে খুব দ্রুত পরিস্থিতি বদলে যাবে, সেই আশায় দিন গুনছি।

সানাইয়া শিল্পাঞ্চলে একাধিক ওয়ার্কশপের বাংলাদেশি মালিক জসিমউদ্দীন বলেন, ‘আমার ওয়ার্কশপগুলো সরকারি নির্দেশে আপাতত বন্ধ। শ্রমিকেরা কর্মহীন। এই দুটি ওয়ার্কশপ কাতারি নাগরিকের ব্যক্তিগত জায়গায় নির্মিত হওয়ায় সরকারিভাবে ভাড়া মওকুফের সুবিধাটি পাইনি। আমাদের জন্যও এমন মওকুফের ঘোষণা আসে কি-না, সেই অপেক্ষা করছি।’

কাতারজুড়ে দোকানপাট বন্ধ। আজ সোমবার পুরোনো দোহায় জনশূন্য রাস্তা। ছবি:প্রথম আলো
কাতারজুড়ে দোকানপাট বন্ধ। আজ সোমবার পুরোনো দোহায় জনশূন্য রাস্তা। ছবি:প্রথম আলো

বিভিন্ন সরকারি বা আধাসরকারি প্রকল্পের নির্মাণকাজে যেসব বাংলাদেশি ঠিকাদার জড়িত, তারা সরকারি সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত হলেও বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতে বাসা-বাড়ি নির্মাণকাজে জড়িত ঠিকাদাররা বেশ চিন্তিত। তবে এখনো ছোট ছোট প্রকল্পে নির্মাণকাজ চলছে। কবে এটিও নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে, সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন অনেক নির্মাণ ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নেতা আবদুল মতিন পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সানাইয়া এলাকার ১-৩২ নম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকায় সেখানে আমার প্রতিষ্ঠানের যেসব শ্রমিকের বসবাস ছিল, তারা এখন কাজে যোগ দিতে পারছে না। অবশ্য এর বাইরে অন্য এলাকায় যারা থাকেন, তারা আমার প্রকল্পগুলোতে কাজ করে যাচ্ছে। তবে মাস শেষে সবাই নিয়মিত বেতন পাবে।’

কাতারজুড়ে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের দোকানপাট। কেবল ফার্মেসি ও নিত্যপণ্যের দোকান খোলা রয়েছে। তবে সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরও অনেক এলাকায় দিনের বেলায় দোকান খোলা রাখছেন কেউ কেউ। ইলেকট্রনিকস পণ্যের বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘরে বসে না থেকে দোকান খুলেছি। তবে শপিংমলের দোকানগুলো পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।’

দূতাবাসের সচতেনতা কর্মসূচি
কাতারের রাজধানী দোহা ও দোহার বাইরে শ্রমিকদের ঘনবসতিপূর্ণ জায়গাগুলোয় গিয়ে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা ও সরকারি বিধিনিষেধ তুলে ধরতে প্রচারণা চালাচ্ছেন কাতারের বাংলাদেশি দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর মুস্তাফিজুর রহমান।
প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে শ্রম কাউন্সেলর বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছি এবং তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় লিফলেট বিতরণ করছি। পাশাপাশি শ্রমিকদের থাকা-খাওয়া বা বেতনভাতা সম্পর্কিত কোনো সমস্যা থাকলে তা সরাসরি শুনে সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছি। সম্প্রতি আমি এলঅ্যান্ডটি, হাই ওয়াশসহ আরও বেশ কিছু কোম্পানির কর্মকর্তা ও সেগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং তাদের সুযোগ-সুবিধার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছি।’
ড. মুস্তাফিজ বাংলাদেশি কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে আমাদের সবার অপেক্ষা করা উচিত। ঝুঁকিপূর্ণ এই সময়ে কাতার সরকারের যাবতীয় বিধিনিষেধ মেনে চলার ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ দেন তিনি।
২২ মার্চ প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যমতে, কাতারে বর্তমানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৯৪ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৩৩ জন।