১০ বছরে দণ্ডিত ৯৫ জন, পলাতক ৪৮

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার পর গত ১০ বছরে ৪১টি মামলায় রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এসব মামলায় দণ্ডিত আসামির সংখ্যা ৯৫। দণ্ডিতদের মধ্যে ৪৭ জন আটক আছেন। বাকি ৪৮ জন দণ্ডিত পলাতক। ট্রাইব্যুনালে এখন বিচার ও প্রাক-বিচার পর্যায়ে রয়েছে ৩৫টি মামলা।

ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আইনি সব ধাপ শেষে শীর্ষস্থানীয় ছয়জন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডসহ ইতিমধ্যে সাত আসামির সাজা কার্যকর হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে ২৬টির বেশি আপিল সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। এ হিসাবে যাত্রা শুরুর ১০ বছর হতে চলছে। শুরুতে পরিচিত ও শীর্ষস্থানীয় অপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এখন চলছে স্থানীয় পর্যায়ের এবং স্বল্প পরিচিত আসামিদের মামলার কার্যক্রম।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, যাত্রা শুরুর পর ২০১৩ সালে দুটি ট্রাইব্যুনাল থেকে নয়টি মামলায় রায় হয়। গত বছর ও এর আগের বছর ছয়টি করে মোট ১২টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানি শাসকেরা চালিয়েছিল বর্বর গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নসহ মানবতাবিরোধী নৃশংসতা। মানবতাবিরোধী এসব অপরাধে হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা বা সরাসরি অংশ নিয়েছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যসহ পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু এদেশীয় দোসর। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যাত্রা শুরু হয় ট্রাইব্যুনালের। ২০১২ সালের ২২ মার্চ গঠন করা হয় আরেকটি ট্রাইব্যুনাল, যা ট্রাইব্যুনাল-২ নামে পরিচিতি পায়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুই ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। বর্তমানে একটি ট্রাইব্যুনালে চলছে বিচার কার্যক্রম।

৪১ মামলা ও দণ্ডিত
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৪১টি মামলায় আদালত দণ্ড দিয়েছেন ৯৫ জনকে। এঁদের মধ্যে ৬৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে ২৫ জনের।

আব্দুল কুদ্দুস নামের এক আসামির ২০ বছরের কারাদণ্ড হয়, যিনি মারা গেছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ৩৬ জন এখনো পলাতক আছেন। এঁদের মধ্যে জামায়াত নেতা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, ফেনীর দাগনভূঞার মো. আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চৌধুরী মঈনউদ্দিন, বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সৈয়দ হাছান আলী, কিশোরগঞ্জ করিমগঞ্জের গাজী আব্দুল মান্নান, ক্যাপ্টেন এ টি এম নাছির ও মো. হাফিজ উদ্দিন, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের আবু সালেহ মুহাম্মাদ আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ ও রুহুল আমিন অন্যতম।

তদন্ত সংস্থার সহসমন্বয়ক এম সানাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারে আসামি গ্রেপ্তারের ক্ষমতা তদন্ত সংস্থার নেই। দণ্ডিত পলাতকসহ আসামির গ্রেপ্তার নিশ্চিতে তদন্ত সংস্থা সব সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়ে চেষ্টা করে আসছে। দণ্ডিত পলাতকদের গ্রেপ্তারে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও অগ্রগতি তেমন দৃশ্যমান নয়। কেবল কিশোরগঞ্জের দণ্ডিত এক আসামিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।

জানা গেছে, দণ্ডিত, বিচারাধীন ও তদন্তাধীন মামলায় পলাতকদের গ্রেপ্তার করতে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৭ সালে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের কাছে আসামিদের নামা–ঠিকানা ও ছবি পাঠিয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, আসামি গ্রেপ্তারের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের। এমনও হয়েছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হলো আসামি পলাতক, অথচ নিজ গ্রামে নিজ বাড়িতে আসামির দাফন হয়েছে। যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে তাহলে পলাতকদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব।

তদন্ত ও মামলার বর্তমান চালচিত্র
রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুসারে, ট্রাইব্যুনালে এখন বিচার ও প্রাক–বিচার পর্যায়ে রয়েছে ৩৫টি মামলা। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ২৩৭। এর মধ্যে কারাগারে আছেন ১২৭ জন, পলাতক ৮৫ জন। ১৯ জন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। বাকিরা জামিনে আছেন।

অবশ্য তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুসারে, ৩৫ মামলায় আসামির সংখ্যা ২২১। এঁদের মধ্যে ৯৭ জন পলাতক ও ৯৪ আসামি আটক আছেন। নয় আসামি জামিনে এবং অপর আসামিরা মারা গেছেন। এ ছাড়া, এখন পর্যন্ত তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ এসেছে ৭৭২টি, যার মধ্যে ৭৭টি অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়েছে। ২৮টি অভিযোগ তদন্তাধীন আছে, যাতে আসামির সংখ্যা ৪০। এর বাইরে ৩ হাজার ৮২৬ জনের বিরুদ্ধে থাকা ৬৯০টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে তদন্ত সংস্থা, যা তদন্ত শুরুর অপেক্ষায়।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে স্বপ্ন নিয়ে জাতি ট্রাইব্যুনালের ওপর আশা রেখেছিল, মনে করি ট্রাইব্যুনাল সে আশা পূরণে সক্ষম হয়েছেন। এর কারণ, ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে যুক্ত বিচারপতি, প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থা ও ডিফেন্স সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকেছেন।’ তিনি বলেন, এটি ঠিক যে ৬০০–এর বেশি অভিযোগ তদন্তাধীন। একটি ট্রাইব্যুনাল সাধারণত বছরে তিন থেকে চারটি রায় দিতে পারেন। তদন্তাধীন অভিযোগগুলো বিচারের জন্য এলে কয়েক শ বছর লেগে যাবে, যে কারণে দ্রুত অপর ট্রাইব্যুনালটি সচল করা প্রয়োজন।

শীর্ষ সাত অপরাধীর দণ্ড কার্যকর
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে শীর্ষ পর্যায়ের ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাঁরা হলেন, জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলী এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আর বিচারিক সব প্রক্রিয়া শেষে এখন আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।

এর বাইরে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম মারা যাওয়ায় তাঁদের করা পৃথক আপিল অকার্যকর বলে ঘোষিত হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আব্দুস সুবহান চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ায় তাঁর করা আপিল গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সমাপ্ত ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ।

এর বাইরে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের করা আপিলের ওপর গত ৩১ অক্টোবর রায় দেন আপিল বিভাগ। রায়ে আজহারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ১৪ জানুয়ারি রায় দেন আপিল বিভাগ।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় আইনে, দেশীয় বিচারব্যবস্থায়, সীমিত লোকবল ও অর্থবল নিয়ে গত ১০ বছরে প্রায় ১০০ গণহত্যাকারীর বিচার ট্রাইব্যুনাল সম্পন্ন করেছেন। এটি কম অর্জন নয়। এখন সময় এসেছে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল সচল করে জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানি হাইকমান্ডসহ অন্যান্য ঘাতক সংগঠনের বিচার দ্রুত আরম্ভ করা দরকার। একই সঙ্গে ট্রাইব্যুনালে দক্ষ জনশক্তি ও প্রয়োজনীয় সুযোগ–সুবিধার জোগান দিতে হবে।