২৫ শতাংশ মানুষ ঠিকমতো হাত ধোয় না

দেশের মানুষের হাত ধোয়ার অভ্যাস আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু এখনো দেশের এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষের সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তৈরি বহু নির্দেশক গুচ্ছ জরিপে (মিকস) এ চিত্র উঠে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বিবিএস এই জরিপ করে।

মিকস জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১২-১৩ সালে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
জরিপ পরিচালনাকারীদের অন্যতম বিবিএসের পরিচালক মো. মাসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ৬৪ হাজার ৪০০ নমুনা নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, এর মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষের হাত ধোয়ার অভ্যাস নেই বা সচেতনতা নেই। সরাসরি সাক্ষাৎকার এবং যেখানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে, সেই জায়গা পর্যবেক্ষণ করে জরিপের কাজ করা হয়েছে বলে জানান মাসুদ আলম।

তবে জনস্বাস্থ্য ও পানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মিকস জরিপে ২৫ শতাংশ বলা হলেও বাস্তবে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে হাত ধোয়া মানুষের সংখ্যা আরও কম হবে।

সাক্ষাৎকার ও হাত ধোয়ার স্থান দেখে হাত ধোয়ার অভ্যাস নির্ণয়ে অনেক ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ চিত্র নাও আসতে পারে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের হেড অব প্রোগ্রামস আফতাব ওপেল। তিনি বলেন, হাত ধোয়া নির্ধারণে প্রক্সি ইন্ডিকেটর ব্যবহার করা হয়। সাবান ও পানি যদি কোথাও থাকে তবে ধরে নেওয়া হয় যে সেখানে ব্যবহার করা হয়। বাস্তবে হাত না ধোয়ার পরিমাণ আরও বেশি হবে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এনভায়রনমেন্টাল ইন্টারভেনশন ইউনিটের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, কেউ পানি ব্যবহার করেছে কি না, সেটা একজন উত্তরদাতার সৎ মতামতের ওপর নির্ভর করে নির্ণয় করতে হয়। আর তা করতে গেলে উত্তরদাতা যদি ভুল তথ্য দেন, তবে বলার কিছু থাকে না। এ জন্য কাঠামোবদ্ধ পর্যবেক্ষণ দরকার। এ জন্য হাত ধোয়ার অভ্যাস জানতে চার থেকে ছয় ঘণ্টা ব্যয় করা দরকার।

হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে মানুষ যে অনেক সময় সত্য তথ্য দেয় না, এমন প্রমাণ আছে একটি গবেষণায়।

যুক্তরাজ্যের কুইনমেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন এবং লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের করা এক যৌথ জরিপে এই উত্তরদাতাদের উত্তর দেওয়ার বৈসাদৃশ্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যের মোটরওয়ে সার্ভিস স্টেশনে থাকা শৌচাগার ব্যবহারকারীদের জিজ্ঞেস করলে ৯৯ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, তাঁরা তাঁদের হাত ধুয়েছেন ভালো করে। তবে পরে যন্ত্রের ব্যবহারে দেখা যায়, ৩২ শতাংশ পুরুষ ও ৬৪ শতাংশ নারীই হাত ধোননি।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনার সংক্রমণকে ‘মহামারি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে ইতিমধ্যে। বাংলাদেশেও আজ শনিবার পর্যন্ত ৪৮ জন শনাক্ত হয়েছেন। আর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এযাবৎ পাঁচজন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সাবান, তরল সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে বারবার হাত ধোয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু দেশের ২৫ শতাংশের বেশি মানুষের হাত ধোয়ার অভ্যাস না থাকার বিষয়টিতে নীতিনির্ধারণী স্তর থেকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, যদি ২৫ শতাংশও ধরা হয়, তবু এ সংখ্যা বেশি। কারণ, এর অর্থ হলো, চার কোটির বেশি মানুষের স্বাস্থ্যসম্মতভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস নেই। এ পরিস্থিতি উত্তরণে যথেষ্ট সজাগ হওয়ার দরকার আছে।

পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু মানুষ সুযোগ থাকলেও হাত ধোয় না। আবার অনেক মানুষ আছে, যাদের হাত ধোয়ার সরঞ্জাম অর্থাৎ পানি ও সাবান ব্যবহারের সুযোগ নেই। হাত ধোয়ার অভ্যাস বাড়াতে দুই শ্রেণির মানুষের জন্য দুই ধরনের ব্যবস্থা জরুরি।

ওয়াটার এইডের আফতাব ওপেল বলেন, রাজধানীর বস্তিবাসী ১০ শতাংশ মানুষ অথবা রাস্তাঘাটে থাকা মানুষের কোনো হাত ধোয়ার ব্যবস্থাই নেই। তাদের কাছে হাত ধোয়ার প্রচার বাড়তি মানসিক অস্বস্তি তৈরি করছে। তাদের জন্য আগে সামগ্রীর ব্যবস্থা দরকার।

জনগণের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) । সিটি করপোরেশন এলাকা বাদ দিয়ে দেশের সর্বত্র এ পরিষেবা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ডিপিএইচইর প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যে ২৫ শতাংশ মানুষের হাত ধোয়ার অভ্যাস নেই, তাদের মধ্যে প্রায় ১২ শতাংশ অতিদরিদ্র মানুষ। যাদের পক্ষে একটা হ্যান্ডওয়াশের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। শ্রমজীবীরা ২০ টাকা পেলে কিছু কিনে খায়। তাদের কাছে পরিষ্কারের সামগ্রীর চেয়ে খাদ্য বেশি দরকার। কীভাবে এসব মানুষকে পরিচ্ছন্নতাসামগ্রীর জোগান দেওয়া যায়, তার জন্য ইউনিসেফের সঙ্গে একটি সমীক্ষা চলছে।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম মনে করেন, দারিদ্র্যের চেয়েও সচেতনতার অভাবই হাত ভালো করে না ধোয়ার বড় কারণ। মন্ত্রী বলেন, ‘দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে অস্বীকার করছি না। কিন্তু যাদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো, তাদের মধ্যেও সচেতনতার অভাব আছে। এখন সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা চেষ্টা করছি।’