মানুষ কেন চিকিৎসা থেকে দূরে থাকছে

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও ইউরোলজি হাসপাতালে রোগীর ভিড় নেই। ইউরোলজি বিভাগের বহির্বিভাগে গতকাল শনিবার রোগী এসেছিল ১৪ জন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অন্য সময় দৈনিক গড়ে ২০০ রোগী বহির্বিভাগে সেবা নেয়।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রভাব পড়েছে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এই বিশেষায়িত হাসপাতালে। এই হাসপাতালের পরিচালক নূরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, অল্প খরচে এখানে রোগীরা ডায়ালাইসিস করেন। তাঁদের হাসপাতালে না এসে উপায় নেই। বহির্বিভাগে রোগী অনেক কমে গেছে।

শুধু এই হাসপাতালে নয়, সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে রোগী কমেছে। এমনকি চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারেও রোগীর তেমন ভিড় নেই। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে মানুষ হাসপাতালে কম যাচ্ছে। খুব জরুরি অসুস্থতা ছাড়া মানুষ হাসপাতালে যেতে চাইছে না। আবার ব্যক্তিগত সুরক্ষার নিশ্চয়তা না থাকায় চিকিৎসকদের কেউ কেউ রোগী দেখা থেকে বিরত থাকছেন। সরকারি হিসাবে, ইতিমধ্যে চারজন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালের প্রায় ৫০ জন চিকিৎসক হোম কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) আছেন।

প্রবীণ চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, রোগ কমেনি। মানুষ রোগে চিকিৎসা নিচ্ছে না বা চিকিৎসা নিতে পারছে না। এর একটি দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, আজ যার অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা, তা যদি না হয়, তাহলে বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঘোষণা প্রথম আসে ৮ মার্চ। এর ১০ দিন পর অর্থাৎ ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর তথ্য আসে। এরপরই চিকিৎসকদের সংক্রমিত হওয়ার ঘটনাগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। হাসপাতালেও রোগী কমতে থাকে।

রোগী কমেছে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম বৃহৎ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এই হাসপাতালে আসা রোগীর কারণে রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় দিনের প্রায় সব সময় ভিড় থাকে। সবচেয়ে ভিড় থাকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে। গতকাল বেলা দুইটায় গিয়ে কোনো রোগী বা চিকিৎসক দেখা যায়নি।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বহির্বিভাগ, অন্তর্বিভাগ—সবক্ষেত্রেই রোগী কমেছে।

এই হাসপাতালের পরিচালকের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, বহির্বিভাগে দৈনিক ৮ থেকে ১০ হাজার রোগী চিকিৎসা নেয়। এখন নিচ্ছে ১ হাজার। অন্তর্বিভাগে গড়ে ১ হাজার ৬০০ রোগী ভর্তি থাকে। গতকাল ভর্তি ছিল ৯০০ রোগী।

রোগী কমেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মহাখালীর হাসপাতালে। এই হাসপাতালে সারা বছর মানুষ বিনা মূল্যে ডায়রিয়া ও কলেরার চিকিৎসা নেয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত দুই দিন গড়ে ১৮০ জন মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে। গত বছর এই সময় গড়ে ৫০০ মানুষ চিকিৎসা নিয়েছিল।

রোগী কমেছে ঢাকা, মুগদা, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালগুলোতেও রোগী কমেছে। গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ ও ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদেরও রোগী কমেছে।

গত সপ্তাহে দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘চেম্বার বন্ধ রাখব। ঝুঁকি নেব না।’ গতকাল একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘চেম্বারে বসছি না। রোগীদের মুঠোফোনে পরামর্শ দিচ্ছি।’ গত কয়েক দিনে অনেক চিকিৎসক তাঁদের ফেসবুকে চেম্বার বন্ধ রাখার কথা বলে দিয়েছেন।

অসুস্থতা ছিল, আছে

হাসপাতালে মানুষ যাক বা না যাক, চিকিৎসকের চেম্বার খোলা থাকুক বা না থাকুক, মানুষের অসুস্থতা আছে, মানুষ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এই সময় দেশে সাধারণ ফ্লু দেখা দেয়। বসন্ত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দেশের একটি এলাকায় হামে আক্রান্ত হওয়ার সংবাদও প্রকাশ পেয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব বলছে, ১ থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে ১১ হাজার ৯৩০ জন মানুষ শ্বাসতন্ত্রের রোগে চিকিৎসা নিয়েছিল। একই সময়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল ২৩ হাজার ৪২০ জন। আর অন্যান্য অসুস্থতায় চিকিৎসা নিয়েছিল ১৮ হাজার ৮২০ জন।

এই হিসাব শুধু সরকারি হাসপাতালের। এর বাইরেও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকেও বহু মানুষ চিকিৎসা নিয়েছে। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারেও বহু মানুষ প্রতিদিন চিকিৎসা নেয়।

করণীয়

মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহিত কামাল নিজের চেম্বারে রোগী দেখছেন না। বিভিন্ন ক্লিনিকের অধীনে ভর্তি হওয়া রোগী অবশ্য তিনি দেখছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই সময় বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সেবা দেওয়া ও নেওয়ার বিষয়কে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সাধারণ জ্বর বা হাঁচি-কাশি নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই। এই সেবা ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করে নেওয়া সম্ভব। এই নম্বর থেকে ২৪ ঘণ্টা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা মানুষের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সেবা দেওয়ার সময় এসেছে। এই মুহূর্তে চিকিৎসা দরকার এমন রোগ ছাড়া হাসপাতালে ভিড় করার প্রয়োজন নেই।

সরকারও মানুষকে হাসপাতালে না যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) আমিনুল হাসান বলেন, প্রতিটি জেলায় কল সেন্টার করা হচ্ছে। ওই কল সেন্টারে কল করার পর রোগীকে জানানো হবে তার হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নেওয়ার দরকার আছে কি নেই। খুব শিগগির এটা কার্যকর করা হবে।

ঢাকার বাইরের চিত্র

ঢাকার বাইরে ভর্তি রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক বা কোথাও তারও কমে নেমে এসেছে। করোনা মোকাবিলায় আইসোলেশন ইউনিট খোলার কথা জানিয়েছে বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলো। হাসপাতালগুলোতে পৃথক হাঁচি-কাশি কর্নার করে এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আবার কোনো হাসপাতালে পোস্টার সাঁটিয়ে দিয়ে সেখানে থাকা ফোন নম্বরে সর্দি-কাশি রোগীদের যোগাযোগ করে চিকিৎসা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা ৭০টির মতো হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে এমন চিত্র পেয়েছেন।

রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শওকত আকবর বলেন, ‘করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় শহরে মাইকিং করে প্রচার করেছি, যেন সামান্য অসুখ নিয়ে কেউ হাসপাতালে না আসেন।’