অফুরন্ত অবসরের পীড়া কাজলদের

ক্রেতা নেই। দোকানের বেঞ্চ পরিষ্কারই সার কাজল ঘোষের। পল্লবী রোড, সিলেট মহানগর, ৩০ মার্চ। ছবি: প্রথম আলো।
ক্রেতা নেই। দোকানের বেঞ্চ পরিষ্কারই সার কাজল ঘোষের। পল্লবী রোড, সিলেট মহানগর, ৩০ মার্চ। ছবি: প্রথম আলো।

সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত—সারাক্ষণ মানুষে গিজগিজ। হাতে চায়ের কাপ। মন-মুখ গল্পে মশগুল। রাজনৈতিক-সামাজিক-পারিবারিক কত কিছু নিয়ে আলোচনা। চা বানিয়ে কূল করতে পারতেন না কাজল ঘোষ। সপ্তাহখানেক আগের সেই দৃশ্য এখন উধাও। তাঁর দোকানে যেখানে মানুষের বসার জায়গা মিলত না, এখন সেখানেই খাঁ খাঁ শূন্যতা। দিনভর কয়েক শ কাপ চা বানানোর কারিগর কাজলের এখন অফুরন্ত অবসর। কিন্তু সেই অবসর তাঁকে পীড়া দিচ্ছে। ভাবাচ্ছে, আয়হীন সামনের দিনগুলো তাঁর চলবে কীভাবে?

কাজলের চায়ের দোকানের নাম ‘মহামায়া স্টোর’। অবস্থান নগরের পশ্চিম পাঠানটুলা এলাকার পল্লবী রোডে। গতকাল সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, ক্রেতার অপেক্ষায় কাজলের দোকান। অর্ধেক শাটার খোলা রেখেছেন কাজল। বিস্কুট, পানীয় ও চানাচুরের প্যাকেটে ধুলো জমেছে। কেটলিতে গরম পানি ফুটছে। কিন্তু চা বানানোর আদেশে দেওয়ার কেউ নেই।

একটি কাপড়ের টুকরো দিয়ে বেঞ্চগুলো মুছতে মুছতে কাজল ঘোষ বললেন, করোনাভাইরাসের আতঙ্কে লোকজন বাসার বাইরে বেরোচ্ছেন না। তিনিও সরকারি নির্দেশ মেনে বেশির ভাগ সময় দোকান বন্ধ রাখছেন। পেটের দায়ে সকাল ও সন্ধ্যা দুই বেলা কিছু সময়ের জন্য দোকান খোলা রাখছেন। তবে ক্রেতা আসছেন না। আয়হীন এ অবস্থায় কীভাবে তিনি সংসার সামলাবেন, এ চিন্তায় অস্থির। স্বাভাবিক সময়ে দিনে গড়ে ৩০০ কাপ চা বিক্রি করেন তিনি, এখন দুই বেলা মিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ কাপও বিক্রি করতে পারছেন না।

কাজল ঘোষের দোকানভাড়া প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকা; বিদ্যুৎ বিল ৫০০ টাকা। এর বাইরে এলপি গ্যাস বাবদ দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। এ গেল দোকান চালানোর খরচ। রয়েছে পরিবারের পেছনে বড় খরচ। ঘরভাড়া বাবদ মাসে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। সংসারের কেনাকাটায় মাসে লাগে গড়ে ১০ হাজার টাকা। দোকানের জন্য কিছুদিন আগে মালামাল কিনেছেন। সেসব বিক্রি না হওয়ায় এখন সেই টাকাও আটকে আছে। একে তো লোকজনের চলাচল নেই; এর মধ্যে দিনের অধিকাংশ সময় দোকান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। রোজগার কমে যাওয়ায় খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

কাজল বলেন, ‘দুই ছেলে আর স্ত্রী নিয়া আমার সংসার। বড় ছেলে করেরপাড়া এলাকার মন্দির স্কুলে প্লে শ্রেণিতে পড়ে। প্রশাসনের নির্দেশ মাইনা ২৫ মার্চ থাকি দোকান বন্ধ রাখছি। কিন্তু খাওয়ার খরচ আইব কই থাকি? তার লাগি সকাল ও সন্ধ্যায় দুইবার কিছু সময়ের লাগি দোকান খুলি। কিন্তু মানুষজন আগের মতো আসে না। তাই কয় দিন ধইরা বেচাবিকি একেবারেই নাই। দোকান খরচ আর ঘরের খরচ কেমনে চলব, সেইটাই এখন ভাবতাছি। মাত্র কয় দিন দোকান বন্ধ থাকতেই চোখে অন্ধকার দেখতাছি।’

কাজলের আদি বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার লালাবাজারের টেংরা গ্রামে। নয় বছর আগে তিনি পল্লবী রোড এলাকায় এই চায়ের দোকান দেন। একই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে তিনি থাকছেন। করোনার আতঙ্ক শুরুর আগে প্রতিদিন তাঁর চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার বেচাকেনা হতো। এখন মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বিক্রি হয়। এ অবস্থায় সামনের মাসে দোকান ও সংসারের খরচ কোথা থেকে আসবে, সেই চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না কাজলের। বললেন, ‘আমার সুখের জীবনে হঠাৎ কইরাই অন্ধকার নাইমা আইছে।’