করোনায় পেশা ও ব্যবসায়ের ধরন বদলাচ্ছে

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাঁশের টুকরিতে মরিচ নিয়ে বসে আছেন পেশা পাল্টানো বজলুর রহমান। চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ, ১ এপ্রিল। ছবি: গোলাম রাব্বানী
করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাঁশের টুকরিতে মরিচ নিয়ে বসে আছেন পেশা পাল্টানো বজলুর রহমান। চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ, ১ এপ্রিল। ছবি: গোলাম রাব্বানী

প্রায় ২০ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ নগরে রংমিস্ত্রির (ভবন রঙের) কাজ করে আসছিলেন বজলুর রহমান (৪৭)। দৈনিক ও চুক্তি ভিত্তিতে কাজ। সেই আয়ে স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে কোনো রকমে খেয়েপরে দিন কাটছিল। তবে করোনাভাইরাসের প্রকোপে নগরজীবন থমকে যাওয়ার সঙ্গে বজলুরের কাজও থেমে গেছে। ঘরে বসে থাকলে পেট চলে না। বাঁশের টুকরিতে বোম্বাই মরিচ নিয়ে তাই নেমে এসেছেন শহরের পথে। রংমিস্ত্রি বজলুর এখন নারায়ণগঞ্জ শহরে মরিচের ফেরিওয়ালা।

করোনায় বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে প্রিয়জনদের নিয়ে টিকে থাকার প্রয়োজনে নিজের পেশা বদল করেছেন বজলুর রহমান। বজলুরের মতো এমন অনেক শ্রমজীবী নিজেদের পেশা এবং ব্যবসায়ের ধরন পাল্টে টিকে থাকার লড়াই করছেন। বুধবার নারায়ণগঞ্জ শহরে ঘুরে কথা হয় এমন কিছু শ্রমজীবীর সঙ্গে।

চৈত্রের দুপুরে মরিচের টুকরি মাথায় নগরের সড়কে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত বজলুর। চাষাঢ়া সমবায় মার্কেটের ফুটপাতে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। নতুন কেনা বাঁশের টুকরিতে শতাধিক বোম্বাই মরিচ তাঁর সামনে। সেখানেই কথা হয়। গত ২৩ মার্চ থেকে কাজ বন্ধ হওয়ার পর ঘরে বসেই কাটিয়েছেন। তবে সঞ্চয়ের টাকা শেষ হওয়ায় আর ঘরে থাকা যায়নি। ৩০০ টাকার বাঁশের টুকরি, ২ হাজার ৭৫০ টাকার মরিচ, ২০০ টাকার ডালা আর ৩০ টাকার পলি ব্যাগ নিয়ে নগরের সড়কে নতুন ব্যবসা শুরু। বজলুর জানান, আগে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার টাকা আয় ছিল। এখন আয় তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ টাকা। এই আয়ে সংসার না চললেও জীবন বাঁচবে।

করোনার ভয় আছে বজলুরের। তবে এর চেয়ে বড় ভয় ক্ষুধার। বজলুরের ভাষায়, ‘করোনার ডর আছে, তারচে বড় ডর খিদার। পেট তো আর করোনা বুঝে না। যেই হাতে কাম কইরা খাইছি, ওই হাতে সাহায্য চাওয়াও সম্ভব না। একটা কিছু করতেই হয়।’

বজলুরের মতো নিজের পেশা বদলেছে ২০ বছরের তরুণ মো. হৃদয়ের। বাবা বেঁচে নেই। ছোট ভাই আর মাকে নিয়ে সংসার। একটি তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করে চলত হৃদয়ের সংসার। উৎপাদন ভিত্তিতে মজুরি। গত ২৬ মার্চ করোনাভাইরাসের কারখানা বন্ধের পর থেকে ঘরে বসেই কেটেছে। সঞ্চয় ফুরোনোর পর গত মঙ্গলবার থেকে শহরের পথে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে নেমেছেন হৃদয়। বুধবার সকালে বন্দর খেয়াঘাট থেকে নগরের ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার পথে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। হৃদয় বলেন, প্রথম দিনে ৫০০ টাকা আয় হয়েছে। কারখানা চালু না হওয়া পর্যন্ত রিকশা চালিয়েই সংসার চালাবেন তিনি।

এমন পেশা বদলের পাশাপাশি ব্যবসায়ের ধরনও পাল্টেছে অনেক শ্রমজীবীর। মোস্তফা মিয়া (৫৭), কামরুল হাসান (১২) তাঁদেরই দুজন। শহরের সড়কে ঝালমুড়ি বিক্রি করে চার সদস্যের সংসার চলত মোস্তফা মিয়ার। করোনার ভয়ে মানুষ বাইরের খাবার বাদ দিয়েছে। বাধ্য হয়েই ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালের সামনে মাস্ক বিক্রি শুরু করেছেন। মোস্তফা মিয়া বলেন, শুরুতে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা মাস্ক বিক্রি হলেও এখন তা দুই থেকে আড়াই শো টাকায় নেমে এসেছে।

মোস্তফা মিয়ার পাশেই একটি বাক্সের ওপর কিছু মাস্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ১২ বছরের শিশু কামরুল হাসান। সেখানেই জানা হয় তার গল্প। স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র কামরুল পরিবারের সঙ্গে জিমখানা রেলওয়ে কলোনির একটি ভাড়া বাসায় থাকে। মেরুদণ্ডে সমস্যা নিয়ে বাবা শয্যাশায়ী। করোনার কারণে হোসিয়ারি শ্রমিক মা কাজ হারিয়েছেন। বড় ভাই শরীফ উদ্দিনও হোসিয়ারি শ্রমিক। সেই হোসিয়ারিতে উৎপাদিত মাস্ক হাসপাতালের সামনে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছে সে। কামরুল জানায়, গত ২৫ মার্চ পর্যন্ত হাসপাতালের সামনে পেয়ারা, আমড়া ও জাম্বুরা বিক্রি করেছে। এখন আর কেউ বাইরের খাবার খায় না। কয়েক দিন ঘরে বসে থেকে বুধবারই প্রথম মাস্ক নিয়ে বের হয়েছে। তবে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা মন্দ। একবেলায় মাত্র ৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে। প্রথম শ্রেণি থেকেই ফল বিক্রির অভিজ্ঞতা কামরুলের। সে ঠিকই জানে, মানুষজন না বের হলে কেনাবেচাও জমবে না।

নানা কথার ফাঁকে কামরুলের কাছে জানতে চাওয়া হয়, করোনাভাইরাস নিয়ে তার ভয় আছে কি না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয় কামরুল, ‘সবাই ঘরে ঘরে মাস্ক বিলাইছে। এহন আর কেউ ঘর থেইকা বাইর হয় না, মাস্কও কিনে না। ভাই কইলো ওনাগো মাস্ক বানানো কইমা গেছে। আর মায় কইছে, অভাব–অনটন শুরু হইছে। সামনে মহাবিপদ।’