অষ্টগ্রামে করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতন হচ্ছে না গ্রামবাসী

কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জ

ফজলুল করিম কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামের আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। করোনা প্রতিরোধে কোনোভাবেই ইউনিয়নবাসীকে সরকারঘোষিত নিয়ম পালনে অভ্যস্ত করে তুলতে পারছেন না তিনি। এ নিয়ে মনঃকষ্টের শেষ নেই তাঁর। শত বুঝিয়েও গ্রামবাসীকে ঘরে পাঠাতে পারছেন না তিনি। বন্ধ হচ্ছে না হাটবাজারে আসা। ঘন ঘন হাত ধোয়ায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি তারা। এ অবস্থায় করোনা প্রতিরোধ নিয়ে তিনি এখন খুবই উদ্বিগ্ন।

ফজলুল করিম বলেন, ‘শুরুতে ভালোই ছিলাম। কথা শোনাতে পেরেছি। লকডাউন হওয়ার পর বিভিন্ন এলাকায় যাঁরা চাকরি করতেন, এমন কয়েক হাজার মানুষ গ্রামে ঢুকেছেন। এরপর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এখন বিশেষ করে বিকেল হলে তাঁরা দল বেঁধে হাঁটেন, গল্প ও খাওয়াদাওয়া করেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু আদমপুরই নয়, কমবেশি এই চিত্র হাওর উপজেলাটির সর্বত্র। সমাজসচেতন ব্যক্তিদের ভাষ্য, করোনা নিয়ে বিশ্ববাসীর ঘুম না থাকলেও হাওরে এর প্রভাব নেই। এ নিয়ে বিশেষ কোনো ভয় কাজ করছে না বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে। স্থানীয় অনেকে বলেন, করোনা মরতে হাওরে আসবে কেন? অষ্টগ্রাম হলো পুণ্যভূমি। অতীতে কোনো মহামারি অষ্টগ্রামকে স্পর্শ করতে পারেনি। এবারও পারবে না। এমন অনেক ‘যুক্তি’ সামনে এনে লোকজন করোনাকে তাচ্ছিল্য করে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে চলছেন।

স্থানীয় লোকজন জানান, কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলার মধ্যে ৩টি হাওর উপজেলা। এর মধ্যে অষ্টগ্রাম একটি। দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থার কারণে উপজেলার বেশির ভাগ গ্রাম উপজেলা সদর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। চাইলেও অল্প সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। অষ্টগ্রামের প্রবাসীদের বেশির ভাগই ইতালির। করোনার কারণে দেশটির পরিস্থিতি নাজুক পর্যায়ে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে অষ্টগ্রামের অনেকে গ্রামে ফিরে আসেন। ফিরে এসে কেউ স্বেচ্ছায় হাসপাতালে যাননি কিংবা হাসপাতালের নির্দেশনা আমলে নেননি। উপজেলার আদমপুর, আবদুল্লাহপুর ও সদরে তিনটি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। ইউনিট তিনটিতে ১৬ জনকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। গতকাল বুধবার পর্যন্ত ১৩ জন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। আজ বৃহস্পতিবার বাকি তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

তবে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, অষ্টগ্রামে প্রবাস থেকে অনেকে ফিরেছেন। তাঁদের ছোট একটি অংশ কোয়ারেন্টিনে আনা হয়েছে। বাকিরা নিজেদের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করে চলেছেন। যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নতার কারণে প্রচারণাও কম হয়। লোকজনের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতাও কম। বিশেষ করে পরিচ্ছন্ন থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা ও মাস্ক ব্যবহার করা—অনেকের কাছে এখনো অপরিচিত।

পূর্ব আবদুল্লাহপুর গ্রামের সিরাজ উদ্দিন একজন কৃষক। করোনা নিয়ে তাঁর মন্তব্য, অন্য জায়গায় এলেও অষ্টগ্রামে করোনা আসবে না। কারণ অষ্টগ্রাম পুণ্যভূমি। সামাজিক দূরত্বের বিষয়ে উপজেলা সদরের দোকানি হাবিব মিয়ার বক্তব্য, মানুষের লগে মানুষ না লাইগ্গা চলে কেমনে?

উপজেলার বাঙ্গালপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক ভূঁইয়া অষ্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই শঙ্কিত। তিনি বলেন, ‘মাইক মেরেছি। পোস্টার লাগিয়েছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছি। কে শোনে কার কথা। বিকেল হলে লোকজনের সারি আর উচ্ছ্বাস দেখলে মনে হয় এই বুঝি ঈদের নামাজ শেষ করে সেমাই খাওয়ার পর ঘর থেকে বের হলো।’


উপজেলাটিতে করোনাভাইরাস ছাড়ানোর ক্ষেত্রে আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নকে অধিক স্পর্শকাতর ভাবা হচ্ছে। কারণ, ওই ইউনিয়নে ইতালিপ্রবাসী বেশি এবং ফিরেও এসেছেন বেশি। বর্তমানে ওই গ্রামের চিত্র আরও সংকটময়। কথা হয় ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তার খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পুলিশ এনেও ঘরে ঢোকাতে পারছি না। আর ঘন ঘন পুলিশ আসার সুযোগ নেই। কারণ, থানা থেকে আমাদের এখানে পুলিশ আসতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়।’

এ ক্ষেত্রে একই সীমাবদ্ধতার কথা বললেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একাধিকবার বসেছি। বুঝিয়ে বলেছি। যাঁর যাঁর এলাকার দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা দিয়েছি। নিজে মাঠে আছি। এরপরও লোকজনকে ঘরে ঢোকাতে পারছি না।’