মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে সেবা দিচ্ছেন তাঁরা

হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ হাদি জিল্লু ও সোহেল খান। ছবি: সংগৃহীত
হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ হাদি জিল্লু ও সোহেল খান। ছবি: সংগৃহীত

নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের (এনওয়াইপিডি) সার্জেন্ট হুমায়ুন কবীর। ম্যানহাটনে তাঁর কর্ম এলাকা। থাকেন কুইন্স এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি ও মৃত্যুর আতঙ্ক, তখন শরীয়তপুর জেলা শহরের শান্তিনগর এলাকার এই ব্যক্তি নিরলসভাবে দেশটির মানুষের জন্য সেবা করে যাচ্ছেন।

হুমায়ুন কবীরের মতো শরীয়তপুরের অনেক ব্যক্তি মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রবাসীর সেবা করছেন। কেউ অ্যাম্বুলেন্স, কেউ ট্যাক্সিক্যাব বা উবারের গাড়ি চালিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করছেন। কেউবা আবার মুদি দোকান খোলা রেখে মানুষের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। ফার্মেসি খোলা রেখে ওষুধ সরবরাহ করছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অনেক বাংলাদেশি।

২০০১ সালে স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান শরীয়তপুর জেলা শহরের শান্তিনগরের ছেলে হুমায়ুন কবীর। ২০০৫ সালে তিনি নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন সেখানে।

গত সোমবার ফেসবুক মেসেঞ্জারে হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিনিধির। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের আতঙ্ক আর অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি পার করছি আমরা। শুধু সেবা খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ঘরের বাইরে আসছেন। অন্যরা সামাজিক দূরত্ব মেনে ঘরে থাকছেন। এনওয়াইপিডির অনেক সদস্যর করোনা পজিটিভ হয়েছে। সংক্রমণের ভয়ের মধ্যেই দায়িত্ব পালন করছি। পরিবারের সদস্যরা ঘরবন্দী আর আমরা মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছি। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করবেন।’

শরীয়তপুর সদরের শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা নুরুল আমীন বলেন, ‘হুমায়ুনের সঙ্গে আমরা একই স্কুলে পড়েছি। করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সেখানে আমাদের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় দায়িত্ব পালনে অবিচল আছেন। ভাবতেই বুকটা গর্বে ভরে যায়। বিপর্যয়ের মধ্যে ভিন দেশে মানুষকে এমন সেবা দেওয়ায় হুমায়ুন এখন রীতিমতো মহল্লার হিরো। এলাকার প্রত্যেকেই তাঁর প্রশংসা করছেন।’

ডামুড্যার সিড্ডা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ হাদি জিল্লু। ২০০৯ সালে স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান তিনি। থাকেন নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনে। সেখানে আন্তর্জাতিক একটি পরিবহন পরিষেবা কোম্পানিতে কাজ করেন। প্রতিনিয়তই থাকতে হয় মানুষের সেবায় নিয়োজিত। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুক মেসেঞ্জারে সৈয়দ হাদি জিল্লু প্রথম আলোকে বলেন, তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন তিনি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে সন্তানদের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। স্ত্রী তাদের নিয়ে ঘরে থাকতে পারলেও তাঁকে প্রায়ই বাইরে যেতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বাংলাদেশি মারা গেছেন। অনেকে আক্রান্ত, সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়। গত সপ্তাহে নড়িয়ার এক প্রবীণ ব্যক্তি মারা গেছেন। খবর পেয়েও যেতে পারেননি। আল্লাহ বিশ্ববাসীকে এ কেমন বিপদে ফেললেন।

গোসাইরহাট উপজেলার এক যুবক ১৫ বছর ধরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জ্যামাইকাতে থাকেন। তিনি সেখানে একটি অ্যাম্বুলেন্সের চালক। জরুরি সেবা খাতে কাজ করায় তাঁর ছুটি মেলেনি। রোগীদের নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই যুবক প্রথম আলোকে বলেন, অন্য রকম এক দুর্যোগের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবাসী সময় পার করছে। প্রত্যেক মানুষ একে অপরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। করোনায় আক্রান্ত লক্ষাধিক মানুষ, মৃত মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। এমন একটি রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির মধ্যে পরিবার থেকে আলাদা থাকতে হচ্ছে।

শরীয়তপুর সদরের তুলাশার এলাকার বাসিন্দা সোহেল খান। ২০১০ সাল থেকে তিনি পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যামাইকাতে থাকেন। সেখানে উবারের গাড়ি চালান। সোহেল খান মেসেঞ্জারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জ্যামাইকা, জ্যাকসনহাইড, চার্জ মেগডোনাল, নিউইয়র্ক, পার্কচেস্টার, ওজন পার্ক ও কুইন্সে বেশি বাংলাদেশি মানুষ থাকেন। আমরা জানি না আমাদের ভাগ্যে কী আছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে সবাই তাকিয়ে আছি। ঘরের মধ্যে আটকা আছি, নীরবে চোখের পানি ফেলছি। অনেক বাংলাদেশি মারা গেছেন। আমার দুই বন্ধু আক্রান্ত হয়েছে। তাদের হাসপাতালেও নিতে পারিনি। ঘরে বসেই চিকিৎসা চলছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিদিন বাংলাদেশিদের মৃত্যু ও সংক্রমিত হওয়ার খবর পাচ্ছি।’

নড়িয়ার ভোজেশ্বর এলাকার সুকুমার রঞ্জন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মুদি দোকানের কর্মী। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একটি নিত্যপণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। চাইলেই ঘরে থাকতে পারছি না। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ঘরেও পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে হচ্ছে। সব সময় আতঙ্ক আর উদ্বেগের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তে মানুষের মৃত্যুর খবর আমাদের বিচলিত করছে।’