করোনা সংকটে কাঁকড়াশিকারিরা

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত কাঁকড়াশিকারি ছয় হাজারের বেশি জেলে পরিবারে দুঃসময় ভর করেছে। আকস্মিকভাবে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার জেলে।

প্রজনন মৌসুমের কারণে বছরের প্রথম দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠতেই করোনাভাইরাসের প্রভাবে মার্চ থেকে রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় অনেক জেলে পরিবার চরম দুর্দশার মধ্যে সময় কাটাচ্ছে।

বেচাকেনা বন্ধ হওয়ায় কাঁকড়াশিকারি জেলেদের মতো স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও পড়েছে চরম বিপাকে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা অনাদায়ি বকেয়া আর দাদন দেওয়া জেলেদের থেকে কাঁকড়া নিতে না পারায় তাঁরাও পড়েছেন অর্থিক সংকটে।

একই কথা সাতক্ষীরার শ্যামনর উপজেলার সুন্দরবন–সংলগ্ন কদমতলা, মীরগাং, গোলাখালী, হরিনগর ও কালিঞ্চিসহ বিভিন্ন গ্রামের কাঁকড়াশিকারি জেলে (লেইয়ে) ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। তাঁদের অভিযোগ, শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকার পাঁচ–ছয় হাজার পরিবার সুন্দরবনের কাঁকড়ার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ২০১৯ সালে দুর্যোগ আর নিষেধাজ্ঞার কারণে সাত মাস সুন্দরবনের নদ-নদীতে কাঁকড়া ধরতে পারেননি তাঁরা।

চলতি বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে প্রজনন মৌসুমের কারণে নিষেধাজ্ঞা ছিল কাঁকড়া ধরার ওপর। এরপর করোনাভাইরাসের কারণে দুর্দশা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।

সরেজমিন শ্যামনগর–সংলগ্ন হরিনগর, কলবাড়ী, নওয়াবেঁকী, ভেটখালী, মীরগাং গোলখালি ও কালিঞ্চি গ্রামের কাঁকড়া শিকার ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে থমকে গেছে তাঁদের জীবন। সরবরাহ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভরা মৌসুমেও কাঁকড়া শিকার ও কেনাবেচা করতে না পারার প্রভাব দীর্ঘদিন টানতে হবে তাঁদের। কর্মশূন্য উপকূলীয় এলাকায় পরিবার–পরিজন নিয়ে কষ্টে তাঁরা দিন পার করছেন।

হরিনগর গ্রামের শুক্কুরী মণ্ডল জানান, তাঁর স্বামী মারা গেছেন। বসতভিটার বাইরে এক ছটাক জমিও নেই। তাই চার সন্তানকে নিয়ে সুন্দরবনের খালে কাঁকড়া ধরে দিন চলছিল। হঠাৎ ব্যবসায়ীরা কাঁকড়া কেনা বন্ধ করে দেওয়ায় দুই সপ্তাহ ধরে আয়–রোজগার বন্ধ। চেষ্টা করেও মানুষের বাড়িতে কাজের সুযোগ না মেলায় সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি।

সাধুপাড়ার সুমন ইসলাম জানান, দুই সপ্তাহ ধরে রোজগার নেই। মহাজনের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। এলাকায় কোনো কাজ নেই। ঋণের টাকাও শেষ হওয়ার পথে। তিনি বলেন, ‘এখন মানুষের থেকে চাইয়ে চিনতে খাতি হবে।’

অভিন্ন কথা কদমতলার জেলে জেহের আলী, মীরগাঙের আনারুল, চুনকুড়ির শাহানাজ, আজিজুল ও আবু তাহেরের। তাঁরা জানান, ধারদেনা আর ঋণের টাকা নিয়ে দিন চলছে অনেকের। পুঁজি শেষ হওয়ায় চেয়ারম্যান ও মেম্বারের কাছে সাহায্যও চেয়েছেন। সব মিলেয়ে রীতিমতো উৎকণ্ঠায় সবাই। মার্চে রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরাও কাঁকড়া কিনছেন না। ভরা মৌসুমে তাঁরা দুরবস্থার মধ্যে পড়েছেন।

চরম অর্থসংকটে ভুগছেন জানিয়ে হরিনগর বাজারের কাঁকড়া ব্যবসায়ী তাপস কুমার মণ্ডল বলেন, কাঁকড়া নেওয়ার জন্য লেইয়েদের (কাঁকড়াশিকারি জেলে) অগ্রিম টাকা দেওয়া ছিল। মার্চ ও এপ্রিলে কাঁকড়া ধরে পুরো টাকা উঠিয়ে দেওয়ার কথা তাঁদের। কিন্তু রপ্তানি বন্ধ থাকায় জেলেরা কাঁকড়া দিলেও তাঁরা নিতে পারছেন না। পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের কাছে তাঁদের সরবরাহ করা চালানের টাকা আটকে গেছে। এ অবস্থায় কর্মচারীদের বেতন দিতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

বাবলুর রহমান ও জাহাঙ্গীর গাজী নামের দুই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, প্রায় ছয় মাস আগে থেকে তাঁরা মার্চ মাসকে ‘টার্গেট’ করে ব্যবসায় নেমেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করোনাভাইরাসের কারণে রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় পুঁজি হারিয়ে তাঁরা রীতিমতো পথে বসে গেছেন।

শ্যামনগর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা তুষার মজুমদার বলেন, কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় কাঁকড়াশিল্পের সঙ্গে জড়িত জেলে, ব্যবসায়ী, শ্রমিকেরা চরমভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাসের প্রভাবে কাঁকড়াশিল্পের সঙ্গে জড়িত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য জোগাড় করেছে।