ঋণ করে অগ্রিম বেতন দিলেন পোশাকমালিক

সুবোল চন্দ্র সাহা
সুবোল চন্দ্র সাহা

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে সবাই কমবেশি সংকটে। অনেক প্রতিষ্ঠান এ পরিস্থিতিতেও জোর করে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে। অনেকে ব্যয় কমাতে শ্রমিক ছাঁটাই করছে বা তাঁদের অর্ধেক বেতন দিচ্ছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক কারখানার বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ উঠছে।

এর মধ্যেও ব্যতিক্রমী উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এসপি গ্রুপ। গাজীপুরে রয়েছে এই গ্রুপের এএমসি নিট কম্পোজিট লিমিটেড ও এসপি ফ্যাশন লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে কাজ করেন ৩ হাজার ৩০০ শ্রমিক-কর্মচারী। করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে গত ২৫ মার্চ থেকে কারখানাটি ছুটি। কিন্তু শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন-ভাতার পাশাপাশি এপ্রিল মাসেরটাও অগ্রিম দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের দেওয়া হয়েছে ঈদ বোনাস ও চাকরি না হারানোর নিশ্চয়তা।

শ্রমিকদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুবোল চন্দ্র সাহা। মঙ্গলবার দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ইউরোপের ক্রেতারা তাদের ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। এরপরই আমরা কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। একটি বেসরকারি ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি। তা দিয়ে ৩ হাজার ৩০০ শ্রমিকদের দুই মাসের বেতন–ভাতা পরিশোধ করেছি।’

অগ্রিম বেতন দেওয়ার বিষয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জে মাত্র ৩০টি যন্ত্র নিয়ে কারখানা শুরু করেছিলাম। বর্তমানে ৩ হাজার ৩০০ শ্রমিক আমার কারখানায় কাজ করেন। আমার গাড়ি–বাড়ি, সরকারের দেওয়া সিআইপি (বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) মর্যাদা—সবকিছুর পেছনে এই শ্রমিকদের অবদান রয়েছে। এই দুঃসময়ে কীভাবে তাঁদের অবদান অস্বীকার করব? শ্রমিকদের হাতে টাকা নেই। মার্চের বেতন খরচ হয়ে গেছে। কারখানা বন্ধ থাকায় এখন তাঁদের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর। এপ্রিলের বেতনটা হাতে থাকলে সংকটে পড়বেন না।’

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত ২৩ মার্চ থেকে দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে তখন তা আমলে নেননি তৈরি পোশাক কারখানার অনেক মালিক। ২৫ মার্চ পোশাক কারখানাগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। এরপর তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ তাদের সদস্যদের প্রতি কারখানা বন্ধের অনুরোধ জানায়। সে অনুযায়ী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ ছিল। তবে এই সাধারণ ছুটির মধ্যেই ৫ এপ্রিল কারখানা চালুর ঘোষণা দেন মালিকেরা। করোনাভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে গাড়িও বন্ধ। এর মধ্যেই বহু কষ্টে কর্মস্থলে ফেরেন লাখো শ্রমিক। এ নিয়ে কঠোর সমালোচনা শুরু হয়। সমালোচনার মুখে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে আবার বাড়ি ফিরে যেতে থাকেন শ্রমিকেরা।

শ্রমিকদের এই দুর্ভোগ নজর এড়ায়নি সুবোল চন্দ্রের। তিনি বলেন, ‘মালিক নয়, একজন নাগরিক হিসেবে শ্রমিকদের এই দুর্ভোগ আমাকে ব্যথিত করেছে। হাজার হাজার শ্রমিক রোদে পুড়ে হেঁটে কর্মস্থলে ফিরেছেন। পরদিন আবার তাঁরা দলে দলে বাড়ি ফিরে গেছেন। আমি করোনাভাইরাসের ভয়ে দিনের পর দিন কারখানায় যাই না। শ্রমিকদের কেমন করে কাজে আসতে বলি?’

সুবোল চন্দ্রের উপলব্ধি, অনেকেই বলছেন, শ্রমিকেরা কেন গ্রামে ফিরে গেলেন। কিন্তু কেউ বোঝার চেষ্টা করছেন না, ওরা ছোট্ট একটা ঘরে চার-পাঁচজন মিলে বাস করেন। একটু ভালো থাকার জন্য গ্রামের চলে যাওয়াটা অন্যায় নয়। এটাই সত্য যে জীবনের সবটুকু সময় দিয়ে শ্রমিকেরাই এই খাতটাকে টিকিয়ে রেখেছেন। এই খাতের মূল চালিকা শক্তি তাঁরাই। তাই শ্রমিকদের অবশ্যই যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে।