দরিদ্রের জমা টাকায় টান দিয়েছে করোনা

কিছুদিন আগে রূপনগর বস্তিতে লেগেছে আগুন। এতে অনেকের ঘরবাড়ি পুড়ে হারিয়েছেন সবকিছু। এখন নেই কোনো উপার্জনের পথ। তীব্র কষ্টে দিন কাটাচ্ছে বস্তিবাসী। ছবিটি গতকাল তোলা। ছবি: সাজিদ হোসেন।
কিছুদিন আগে রূপনগর বস্তিতে লেগেছে আগুন। এতে অনেকের ঘরবাড়ি পুড়ে হারিয়েছেন সবকিছু। এখন নেই কোনো উপার্জনের পথ। তীব্র কষ্টে দিন কাটাচ্ছে বস্তিবাসী। ছবিটি গতকাল তোলা। ছবি: সাজিদ হোসেন।

বাতাসে এখনো পোড়া গন্ধ। প্রান্তরজুড়ে ছড়িয়ে আছে আধপোড়া টিন, বাঁশের খুঁটি আর কয়লা হয়ে যাওয়া আসবাব। মাসখানেক আগেই রূপনগর আবাসিক এলাকার ঝিলপাড় বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না–উঠতেই সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার সামনে রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব।

বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের কারণে ঢাকা এখন কার্যত অচল। সেই সঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এই মহানগরের প্রান্তিক বাসিন্দারা। যাঁদের বেশির ভাগের বসবাস ঝিলপাড়ের মতো শহরের আনাচকানাচে গড়ে ওঠা বস্তিগুলোতে। তবে অন্য বস্তিগুলোতে বাসিন্দাদের মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকু থাকলেও ঝিলপাড়ের চিত্র ভিন্ন। এখনো এই বস্তির বাসিন্দাদের অনেকের দিন-রাত কাটছে খোলা আকাশের নিচে ত্রিপল কিংবা পলিথিনে ঘেরা ছাউনিতে।

গত ১১ মার্চ ঝিলপাড় বস্তির পশ্চিম অংশে সংঘটিত এই অগ্নিকাণ্ডে কয়েক শ ঘর পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন ঘরপোড়া বেশির ভাগ বাসিন্দা। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অনেকে চড়া সুদে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেন। কেউ কেউ টাকা ধার করেন নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে। কিন্তু প্রায় একই সময়ে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে রোজগারের পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে পড়ায় তাঁরা কীভাবে ঋণের টাকা শুধবেন, কীভাবেই–বা পরিবার-পরিজনের নিত্যকার খাবারের চাহিদা মেটাবেন, তা ভেবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

গতকাল বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত এই বস্তির অনেক বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের অসহায় চাহনিই বলে দিচ্ছিল করোনার কারণে সৃষ্ট সংকটের কথা। তাঁদের অনেকের ঘরেই গত কয়েক দিনে হাঁড়ি চড়েনি। এত দিন জমানো যা সামান্য ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। এখন ত্রাণ আর চেয়ে নেওয়া সাহায্যে কোনোরকমে দিন কাটছে।

এদিন রূপনগর আবাসিকের ৯ নম্বর সড়কের শেষ প্রান্তে বস্তিতে ঢোকার মুখে কথা হয় ষাটোর্ধ্ব রওশন আরা বেগমের সঙ্গে। জানান, তিনি ও তাঁর মেয়ে বাসাবাড়িতে কাজ করে কোনোরকমে সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন। ঘরে দুই নাতির এখনো কাজ করে খাওয়ার বয়স হয়নি। আর বয়সজনিত নানা রোগে আক্রান্ত স্বামী কোনো কাজ করতে পারেন না। এই অবস্থায় আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘর নতুন করে তুলতে তাঁরা একটা এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন। কিন্তু এখন মা-মেয়ের দুজনেরই কাজ বন্ধ। রওশন আরা বেগম বলেন, ‘যে ট্যাকা ঋণ নিছিলাম, তা সব ঘরের পিছে ঢালছি। হাতে এখন কিছুই নাই। নিজেরা কষ্ট কইর‌্যা থাকলেও দুই নাতির মুখে তো কিছু দেওয়া লাগে। এখনই দিন চলে না, সামনের দিনে কী হইব ভাইবা পাই না।’

রূপনগর বস্তির আগুনে সব হারানোর পর এখন করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে উপার্জনের পথ। ফলে কষ্টে আছে এই খেটে খাওয়া মানুষেরা। ছবিটি গতকাল তোলা। ছবি: সাজিদ হোসেন।
রূপনগর বস্তির আগুনে সব হারানোর পর এখন করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে উপার্জনের পথ। ফলে কষ্টে আছে এই খেটে খাওয়া মানুষেরা। ছবিটি গতকাল তোলা। ছবি: সাজিদ হোসেন।

বস্তির আরেক বাসিন্দা মফিজুরেরও বিপদের শেষ নেই। তিনি রূপনগরের একটা প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করতেন। করোনার কারণে গত মাসের ২৪ তারিখ থেকে কাজ বন্ধ। এদিকে ঘরে আগুন লাগার আগে গত বছরের অক্টোবর মাসে গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একমাত্র ছেলে মুস্তাকিনের ডান চোখ গলে যায়। ছেলের চিকিৎসার খরচ মেটাতে শেষ সম্বল গ্রামের ভিটেটুকুও বিক্রি করে দেন তিনি। এখন সব হারানো কর্মহীন এই বাবা অসহায় কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘শহরে কাজ বন্ধ। বাড়ি ফেরার উপায়ও নাই। খায়া না–খায়া দিন কাটতাছে। পোলাডার মুখের দিকে চাইতে পারি না। আগুন লাগার পর করোনা আইলেও অনেকে টুকটাক সাহায্য পাইছে। আমি তা–ও পাই নাই। এখন তো চোখে অন্ধকারও দেখি না।’

একইভাবে বস্তির ভেতর বাবুল সরদার নামের আরেক ব্যক্তির পোড়া ঘরের কাছে গিয়ে দেখা গেল, চুলায় ভাত ফুটছে। তরকারি আছে কেবল মিষ্টিকুমড়া। উদাম গায়ে ছোট পাঁচটি ছেলেমেয়ে অপলক চেয়ে আছে চুলায় ফুটতে থাকা ভাতের দিকে। সিটি করপোরেশনের সাবেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাবুল সরদার জানালেন, কয়েক বছর আগে স্বাস্থ্যগত কারণে তাঁর চাকরি চলে যায়। ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে বস্তিতে ঘর তুলেছিলেন। কাজ নিয়েছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এখন কাজ নেই, ঘরও নেই। সকালে এক ব্যক্তি পাঁচ কেজি চাল দিয়েছেন। সেটাই চুলায় চড়িয়েছেন স্ত্রী। কাল কী হবে, তা আর জানা নেই বাবুল সরদারের।