ঢাকার দুই সিটির অসহায় মানুষের সহযোগিতায় আসছে নতুন কর্মসূচি

করোনাভাইরাসের প্রকোপে কর্মহীন হয়ে পড়া অসহায় মানুষকে অর্থসহ নানা সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুধু সরকার নয়, এ উদ্যোগে শামিল করা হয়েছে একাধিক বেসরকারি সংগঠনকে। এ উদ্যোগ নিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র, তাঁদের প্রতিনিধি ব্র্যাকসহ একাধিক এনজিওকে নিয়ে ৬ এপ্রিল এক দীর্ঘ সভাও হয়েছে।

করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেশজুড়ে। এ অবস্থায় সরকার দেশব্যাপী সব সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। এতে সমাজের নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা সমস্যার মুখে পড়েছে। সমস্যার মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সব জেলার প্রশাসকের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের তালিকা করে সহায়তা দেওয়া শুরু হয়েছে। জেলার অধীন বিভিন্ন উপজেলা এবং ইউনিয়নে ইতিমধ্যে সহায়তা শুরু হয়েছে। পৌর শহরগুলোতেও চলছে তৎপরতা। কিন্তু জেলা বা উপজেলা পৌর শহর কিংবা ইউনিয়নে প্রকৃত সুবিধাবঞ্চিত মানুষ খুঁজে বের করা যতটা সহজ, এই বিশাল ঢাকায় তা অসম্ভব। আবার নগরে অনেকেই আছেন যাঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে সবার মতো সাহায্য নিতে পারেন না। সংকটটা এসব মানুষের জন্য আরও প্রকট। এমন অবস্থার মধ্যে পড়ার অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম।

এ উদ্যোগকে ‘অত্যন্ত সময়োপযোগী’ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগর দরিদ্রদের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায় অনেক ক্ষেত্রে। নগরের দরিদ্র মানুষ এবার শুধু আক্রান্ত নন, আর্থিকভাবে সম্পন্ন কর্মজীবী অনেক মানুষও বিপদে পড়েছেন। তাঁদের সহায়তার বিষয়টি যে নীতিনির্ধারণী মহল নজরে এনেছে, এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ।’

৬ এপ্রিল যে সভা হয় সেখানে উত্তর সিটির নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ইউএনডিপি, এনজিও ব্যুরো, ব্র্যাক, ওয়াটার এইড, দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সাজিদা ফাউন্ডেশন এবং শক্তি ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

কেন এ ধরনের উদ্যোগ? স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম এর উত্তরে বলেন, ‘এই বিশাল দুই সিটিতে মানুষকে সহায়তা করা জেলা প্রশাসনের পক্ষে অসম্ভব। আর সেটা জেলা প্রশাসনও স্বীকার করেছে। তাই দুই সিটিসহ একাধিক সংগঠনকে নিয়ে উদ্যোগ নিয়েছি। আর প্রাথমিকভাবে একটি ডেটাবেজ তৈরি করা হবে। এর মাধ্যমে সহায়তা দেওয়া হবে। সরাসরি অর্থসহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি খাদ্যসহায়তা দেওয়া হবে। এমন প্রত্যক্ষ সহায়তার পাশে কোনো মানুষের নিরাপত্তাজনিত কোনো উদ্বেগ যদি থাকে, তাও সেই ব্যক্তি জানাতে পারবেন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মানুষ কাকে জানাবেন? সিটির ওয়ার্ডগুলো তো বড় বড়, সে ক্ষেত্রে কেমন করে হবে মানুষ নির্বাচন?
প্রথম একটি কমিটি করা হবে ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে আহ্বায়ক করে। এতে একজন এনজিও প্রতিনিধি সদস্যসচিব, দুজন এনজিও প্রতিনিধি সদস্য, তিন মসজিদ কমিটি ও আবাসিক এলাকার তিন ব্যক্তিকে নিয়ে মোট ১০ সদস্যের কমিটি হবে। এই কমিটি প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০ ভাগে বিভক্ত করে ১০টি উপকমিটি করবে। এখানে সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি এবং এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা থাকবেন।

এসব কমিটির সদস্যরা তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে এলাকার দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত অসহায় মানুষের তালিকা তৈরি করবেন এবং তাদের চাহিদা জানবেন। তাঁরা অনুদান পৌঁছে দেবেন মানুষদের কাছে। আর এর ফলে এক ব্যক্তির একাধিকবার ত্রাণ পাওয়ার সুযোগ কমবে।
প্রতিটি কমিটির সদস্যের ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে। কেউ চাইলেই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। তাঁদের পরিচয় গোপন রেখে পৌঁছে দেওয়া হবে সহায়তা।

ঢাকা উত্তর সিটির নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘একটি ওয়ার্ডকে ১০ ভাগে ভাগ করলে প্রান্তিক মানুষের তথ্য বেশি করে পাওয়া যাবে। আমরা সঠিক মানুষকে দিতে পারবে। এতে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়বে। কে পাচ্ছে আর কে পাচ্ছে না, এ তথ্য চলে আসবে। সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা আর বিষয়টি স্বচ্ছভাবে করা—এ দুটো আমাদের লক্ষ্য।’

আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকেই আছেন যাঁদের সহায়তার খুব প্রয়োজন, কিন্তু চাইতে পারছেন না। তাঁরা তাঁদের অবস্থা জানাবেন। আমরা সহায়তা দেব।’

ঢাকার ২০ হাজারের দরিদ্র পরিবারকে ১৫ দিনের জন্য ১৫০০ টাকা করে সহায়তা দিচ্ছে ব্র্যাক। অনেকেই মনে করছেন, এ মুহূর্তে অনেকেরই অর্থসহায়তা দরকার। এবার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে সম্পৃক্ত আছে ব্র্যাক। বিশ্বের বৃহত্তম এই এনজিওর পরিচালক কে এ এম মোরশেদ বলেন, ‘বিষয়টি অ্যাসেসমেন্টের মধ্যে আছে। এটা করতে দু-এক দিনের বেশি লাগবে না। যাঁদের নিয়ে কমিটি হবে তাঁরা ওই এলাকার পরিচিতি মানুষ। তাঁরা দ্রুতই করতে পারবেন।’

কে এ এম মোরশেদ বলেন, ব্র্যাকের কাছেই চার লাখ লোকের ডেটাবেজ তৈরি হচ্ছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছেও আছে। এর সঙ্গে মিলিয়ে ডেটাবেজ করা হবে। দরিদ্র মানুষের ডেটাবেজ অনেকের কাছে আছে, যাঁরা এ সহযোগিতা আগে নিয়েছেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে যাঁদের প্রয়োজন তৈরি হয়েছে, তাঁদের ডেটাবেজ করাটা জটিল।’

এ উদ্যোগের সঙ্গে জড়িতরা কেউ কেউ বলছেন, উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও এটা চ্যালেঞ্জিং।
হোসেন জিল্লুর মনে করেন, সুষম বণ্টন এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে সহায়তা পৌঁছানোটাও চ্যালেঞ্জ। তবে এসব মোকাবিলা করা গেলে, আখেরে নগরবাসী অসহায় মানুষের কাছে এর সুফল পৌঁছাবে।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম মনে করেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে এমন ধরনের সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই।