করোনা মোকাবিলায় আরও সমন্বয় জরুরি

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। দেশ এখন সংক্রমণের শেষ স্তরে। এই পরিস্থিতিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছে, হাটবাজারে ঘুরছে, ত্রাণ নিতে ভিড় জমাচ্ছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এটা ঠেকানোর দায়িত্ব কার—স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ত্রাণ মন্ত্রণালয় নাকি অন্য মন্ত্রণালয়ের? নাকি মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না?

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গোটা সরকারব্যবস্থা এখন যুক্ত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ ১৫টি মন্ত্রণালয় এখন এই কাজে যুক্ত। কিন্তু মানুষ আশ্বস্ত হতে পারছে না। মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক কাজ করছে। মানুষ মনে করছে, মন্ত্রণালয়গুলো সমন্বিতভাবে কাজ করছে না। এই ধারণা সত্যি হয়ে ওঠে যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কমিটির প্রধান করা হলেও তিনি অনেক কিছু জানেন না। গার্মেন্টস খোলা বা বন্ধ রাখা, মসজিদে নামাজ আদায় বা রাস্তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হচ্ছে, তা তিনি জানেন না। গত সোমবার রাজধানীর মহাখালীতে পেশাজীবীদের এক অনুষ্ঠানে জাহিদ মালেক এ কথা বলেন।

জাহিদ মালেকের বক্তব্য সমন্বয়হীনতার ইঙ্গিত দেয়। তবে উদাহরণ আরও আছে। একাধিক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার সমন্বয়ের বিষয়টি বেশি আলোচিত হচ্ছে। পেশাজীবী চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় এই মন্ত্রণালয় ঠিক সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।

দরকার ঠিক তথ্য ও বার্তা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, মহামারি পরিস্থিতিতে মানুষকে ঠিক তথ্য ও বার্তা দিতে হবে। ভুল তথ্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য মানুষের আস্থা নষ্ট করে। আস্থা না থাকলে মানুষ রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা থেকে বিরত থাকে, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যেতে চায় না। 

সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। কিন্তু দিনের পর দিন একটি ছোট কক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে আসছিল রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। ২১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কক্ষে দেড় শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিকের সামনে কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ঠাসাঠাসি পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন সাংবাদিকেরা। 

মানুষ ধাক্কা খেয়েছে গত সোমবারের ঘটনায়। পেশাজীবীদের অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে নতুন ২৯ জন আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে। আর মারা গেছে ৪ জন। এক দিনে এত আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

তবে দেড় ঘণ্টা পর আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা নিয়মিত ব্রিফিংয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ভিন্ন তথ্য দেন। ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চান, কার তথ্য ঠিক, জাহিদ মালেকের নাকি মীরজাদী সেব্রিনার। এরপর থেকে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ বন্ধ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে বুলেটিন হিসেবে তথ্য দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কিছু পদক্ষেপ বিভ্রান্তি ও বিতর্কের সৃষ্টি করছে। গত ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, ‘যদি কোনো রোগীর কোভিড-১৯-এর লক্ষণ থাকে, তবে প্রথমে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন এবং প্রয়োজনে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) পরিধানকৃত দ্বিতীয় চিকিৎসকের কাছে প্রেরণ করবেন এবং তিনি পিপিই পরিহিত অবস্থায় রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করবেন।’ সমালোচনার মুখে আদেশটি স্থগিত করা হয়। একই দিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক আদেশে কেউ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হলে সেনাবাহিনীর তল্লাশিচৌকি বা থানার ওসিকে জানানোর কথা বলা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন গণপদত্যাগের হুমকি দেয়। সমালোচনার মুখে সেই আদেশও বাতিল করা হয়। 

তখনই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি সামনে চলে আসে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম তখন বলেছিলেন, আদেশটি তাঁকে না জানিয়ে করা হয়েছিল।

যোগাযোগ চালু রেখে ছুটির ঘোষণা
সরকার প্রথমে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি অফিস টানা ১০ দিনের ছুটি দেয়। ২৩ মার্চ এমন ঘোষণার সময় যোগাযোগব্যবস্থা চালু ছিল। তাই এই ছুটির ঘোষণায় হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়ে। বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে এবং রেলস্টেশনে ঘরমুখী মানুষের ভিড় শুরু হয়। ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়ে।

বিভিন্ন স্টেশনে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করার ঘোষণা আসে। ২৪ মার্চ জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম ঘোষণা দেন, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। একই দিন নৌযান বন্ধেরও ঘোষণা দেওয়া হয়। আর ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়।

তৈরি পোশাক কারখানা
সরকারি অফিস-আদালত ছুটি দেওয়া হলেও প্রথমে তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ করতে চাননি মালিকেরা। এখানে মালিকদের বড় দায় আছে। তবে মালিকদের পাশাপাশি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও দায় আছে। কারণ, প্রথমে ২১ মার্চ শ্রম ভবনে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্বে সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত সভায় কারখানা খোলা রাখার পক্ষে মত দেওয়া হয়। পরদিন শ্রম ভবনে আরেক সভায় সিদ্ধান্ত হয় আপাতত কারখানা চলবে। তবে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সরকার ১০দিন ছুটি দিলে মালিকেরা চাপে পড়েন। এ অবস্থায় বিজিএমইএ ২৬ মার্চ কারখানা বন্ধ রাখতে সংগঠনের সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানায়। এক দিন পর বিকেএমইএও অনুরোধ জানায়। তাতে বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে সরকারের প্রথম দফার ছুটি বাড়ানো হয়। কিন্তু ১ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মালিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক কারাখানা চালু রাখা যাবে। এরপর বিভিন্ন কারখানার পক্ষ থেকে শ্রমিকদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে বলা হয় ৫ এপ্রিল থেকে কারখানা খোলা হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বেতন ও জীবিকার টানে শ্রমজীবী এই মানুষগুলো আগের দিন পরিবহন বন্ধের মধ্যেও হেঁটে বা যে যেভাবে পারেন ঢাকা ও আশপাশের শিল্প এলাকায় আসতে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে ৪ এপ্রিল রাতে বিজিএমইএ কারখানা বন্ধ রাখতে সংগঠনের সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানায়। চরম বিপাকে পড়ের শ্রমজীবী এই মানুষগুলো। 

পুলিশের সঙ্গে সমন্বয়ের সমস্যা
পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে প্রধান করে ১ মার্চ জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে পুলিশের মহাপরিদর্শকে রাখা হয়নি। ফলে জাতীয় কমিটির কোনো সিদ্ধান্ত আইজিপি জানতেন না। এতে করে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের তিনি কোনো নির্দেশনাও দিতে পারতেন না। অবশ্য বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা কমিটিতে পুলিশকে রাখা হয়েছে। 

>মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ ১৫টি মন্ত্রণালয় এখন এই কাজে যুক্ত। মানুষকে সঠিক তথ্য ও বার্তা দেওয়া জরুরি।

জাতীয় কমিটির প্রথম সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ইতালি থেকে প্রথম দফায় আসা ১৬৪ জনকে হজ ক্যাম্পে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে। এ জন্য হজ ক্যাম্প প্রস্তুত করে রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয় ধর্ম মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রবাসীরা। পরে তাঁদের বেশির ভাগকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকিদের গাজীপুরের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়।

প্রবাসীদের ঠিকানা অনুসারে তাঁদের নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান নিশ্চিত করার ব্যাপারে নির্দেশনা আসে দেরিতে। এতে প্রবাসীরা এলাকায় খুশিমতো ঘুরে বেড়াতে থাকেন। পরে অবশ্য নানা উদ্যোগের ফলে অনেককে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়।

করণীয়
এখন ১৬টি ল্যাবরেটরিতে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা হচ্ছে। কোনো ল্যাবরেটরিতে দিনে দুটি পরীক্ষা হচ্ছে। কোনোটিতে ১০০টির বেশি। নমুনা সংগ্রহের ব্যাপারেও সবাই সমান সুযোগ পাচ্ছে না। জেলা-উপজেলা থেকে আসা কিছু নমুনা সঠিকভাবে সংগ্রহ করা হয়নি—এমন নজির পেয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান। 

কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কর্মকাণ্ড কোয়ারেন্টিন ও লকডাউনকে ঘিরে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দূরত্ব তৈরি করতে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতামত না নিয়ে বা তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা কিছু মানুষকেও নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই ঘটনা বুমেরাং হতে পারে। এমন ঘটনা বেশি ঘটলে মানুষ রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা থেকে দূরে থাকবে।

সামাজিক দূরত্বের বিষয় না মেনে মানুষ রাস্তায় আসছে, হাটবাজারে জড়ো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্যে মানুষকে বেশি দিন ঘরে আটকে রাখা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সামাজিক সংগঠন বা রাজনৈতিক সংগঠনকে ব্যবহার করতে হবে। 

হঠাৎ করে শত শত মানুষ জড়ো হচ্ছে ত্রাণ কর্মকাণ্ডকে ঘিরে। মুশতাক হোসেন বলেন, ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে এ ক্ষেত্রে পুলিশ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করতে হবে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তথা বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের সমন্বয় আরও নিবিড়ভাবে হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সমন্বয় না হলে উদ্দেশ্য সফল হবে না।