করোনা যুদ্ধে ভাতের জোগান জরুরি

উড়ালসড়কটা খুঁটির ওপর মরা অজগরের মতো পড়ে আছে। নিচে টঙ্গীর স্টেশন রোড বেলা ১১টায়ও ঝিমাচ্ছে। দু-চারটা রিকশা, গাড়ি; হঠাৎ একটা ফাঁকা পিকআপ। একটা-দুইটা ঝাঁপখোলা মুদি দোকান। পথে পথে পায়ে হাঁটা কিছু মানুষজন, কখনোবা একটু জটলা। রেললাইন পেরিয়ে বিসিকের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প নগরীতে ঢুকি। তারিখটা ৫ এপ্রিল।

কারখানা খোলার কথা থাকায় আগের দিন পোশাকশ্রমিকেরা দলে দলে এলাকায় ফিরেছেন। তবে শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে বেশির ভাগ কারখানাই খোলেনি। দু-একটিতে কিছু মানুষজনের আনাগোনা। পাগাড় এলাকায় বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে অপেক্ষা করছিলেন মমিনুর রহমান। তিনি গত ২৬ মার্চ থেকে নারী স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল গড়ে করোনাযুদ্ধের মাঠে কাজ করছিলেন।

সাবিনা আক্তার  ও মমিনুর রহমান
সাবিনা আক্তার ও মমিনুর রহমান

মমিনুর আমাকে নিয়ে গেলেন এনজিও কর্মজীবী নারীর অফিসে। সেখানে একটি ঘরে দূরে দূরে পাতা চেয়ারে বসেছিলেন চারজন নারী। ‘করোনা প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবক কমিটি’তে সদস্য আছেন ১৪ জন। মমিনুর বাদে সবাই নারী। সদস্যরা বিভিন্ন এনজিওর মাঠকর্মী। কেউ কেউ বিভিন্ন পোশাকশ্রমিক সংগঠনেও যুক্ত আছেন।

এলাকার মানুষদের একটা বড় অংশ পোশাকশ্রমিক। ছোটখাটো অন্যান্য কলকারখানার শ্রমিক আর দিন-এনে-দিন-খাওয়া মানুষও অনেক। এনজিওর এই মাঠকর্মীরা তাঁদের মধ্যেই কাজ করেন, বসবাস করেন।

গোড়ায় তাঁরা ফেসবুকে আলাপ করে ভাইরাস প্রতিরোধের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার কাজে নামলেন। অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছিল, এটাই এখানে আগে দরকার। সাবিনা আক্তার ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মী। তিনি ব্র্যাকের পরামর্শপত্র সবাইকে এনে দিলেন। কিন্তু লকডাউন বা জনপদবন্ধে আরেকটি সমস্যা প্রকট হলো।

সাবিনা বললেন, ‘সচেতন করার জন্য যখন আমরা একেকজনের বাসায় যাইতেছি, তখন আমাদের কাছে একটা প্রশ্ন আসল যে আমরা সচেতন হয়ে কী করব, যদি আমাদের পেটে খাবার না থাকে?’

মমিনুর গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। বহু বছর ধরে এই এলাকায় কাজ করছেন। নিজেও পোশাকশ্রমিক ছিলেন। বিষয়টা তাঁর মাথায়ও ছিল। করোনাবন্ধের মাঠে নেমে তিনি খাদ্যসংকটের মাত্রাটা বুঝলেন। মমিনুরের কথায়, ‘কারও পরিবারে দুই দিনের খাবার আছে, কারও পরিবারে চার দিনের খাবার আছে। এটা একপর্যায়ে শেষ হয়ে যাবে। কারও পরিবারে এখনই নাই। এইটার সমাধান কী হবে?’

ঢাকার উপকণ্ঠের এই শিল্পাঞ্চলে ছোট ছোট ঘরের ভাড়া বাসা অনেক। তবে পাগাড়ের সোসাইটির মাঠ এলাকাটি এখনো ঘিঞ্জি হয়ে ওঠেনি। মমিনুরের সঙ্গে সেখানকার একটি বাসায় গেলাম। পথে দেখি ভ্যানে দীনহীন চেহারার কিছু সবজি নিয়ে মুখঢাকা পরে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী। কেনার লোক কাউকে দেখলাম না।

হাসিনা ও লিটন মিয়ার সংসার
হাসিনা ও লিটন মিয়ার সংসার

নিঝুম গলির ধারে যে বাসায় আমরা গেলাম, সেখানে উঠানের তিন দিক ঘিরে টিনচালা পাকা ঘর। একদিকে বাড়িওয়ালা থাকেন। ভাড়াটেদের ঘরগুলো ব্যারাকের মতো টানা। আছে এজমালি বাথরুম-গোসলখানা আর রান্নার চালা। সবুজ ওড়নায় মাথা ঢেকে দরজায় এসে দাঁড়ান হাসিনা। দেড়-ঘরের বাসায় তিন মেয়েসহ পাঁচজনের সংসার। এক মেয়ে চামচ কারখানায়, আরেকজন প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করে। মেয়েদের কারখানা ‘১০-১৫ দিন ধরিয়াই বন্ধ, বেতন অহনও পাইছে না।’ হাসিনা নিজেও পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। মাস তিনেক আগে ছাঁটাই হয়েছেন।

স্বামী লিটন মিয়া শাক বেচতেন, এখন ‘বেচাকিনি নাই’। মাঝেমধ্যে অন্যের খেতে টুকটাক জন খাটেন। সেদিন দুপুর বারোটায় তিনি বাইরের ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন।

সকালে শুকনো আটারুটি খেয়েছেন। দুপুরে হাসিনা তিন পোয়া চালের ভাত রেঁধেছেন, আর টোকানো শাক ভাজি করেছেন। এটাই পাঁচজনে দুই বেলায় খাবেন। মাসখানেক আগে তিন বেলাই রান্না করতেন হাসিনা। বললেন, ‘অহন তো মনে করইন যহন ইতা গন্ডগোল বাইঞ্ঝা পড়ছে, আউলাঝাউলা চতুর্মুখ দিয়া। দিনখন বালা না। এখন তো যেমুত কামাই, এমুত খরচ।’

করোনাভাইরাসের কথা শুনেছেন তিনি, ‘নাকে দিয়া, মুখে দিয়া ঢোকে মানুষের।’ ভয় লাগে তাঁর। আরও বলেন, ‘গরিব তো এতে মরবই। আমরা কী করিয়া চলবাম?’

স্বেচ্ছাসেবকেরা টঙ্গী পূর্ব থানার এলাকায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ছয়টি ওয়ার্ডে কাজ করছিলেন। যিনি যে ওয়ার্ডে থাকেন, সেখানে। আশা, তাতে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি কমবে। তাঁদের ঢাল-তলোয়ার বলতে ছিল মুখে মুখঢাকা আর হাতে রবারের দস্তানা। ৯ এপ্রিল ফোনে জানলাম, পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় এখন তাঁরা পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।

নিজেদের সাধ্য কম, লোকের কাজকর্ম বন্ধ হলে পরিচিতজনদের কাছ থেকে কিছু টাকা এনেছিলেন মমিনুল। তাতে দিনমজুর ও সবচেয়ে নিরুপায় অল্প কিছু পরিবারকে সামান্য সাহায্য করা গেছে। প্রথম দিকে স্বেচ্ছাসেবকেরা এমন পরিবারগুলোর তালিকা করছিলেন। পরে দেখা গেল, তাতে মিথ্যা আশা তৈরি হচ্ছে। পরে তাঁরা কেবল খোঁজখবর নিয়ে ধারণা করে রাখছিলেন। কেউ চাইলে তালিকা দিতে পারবেন। তাঁরা ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ করছেন শিরিন সুলতানা। তিনি সরকার ও ইউএনডিপির একটি দারিদ্র্য কমানোর কর্মসূচিতে যুক্ত আছেন।

গাজীপুরের মেয়র এই ওয়ার্ডের ৫০০ পরিবারের জন্য সহায়তা পাঠালে শিরিনকে কাউন্সিলর ১৫ জনকে দিতে বরাদ্দ দেন। তবে এ সাহায্য কেবল এলাকার ভোটাররাই পেয়েছেন। স্বেচ্ছাসেবকেরা বলছেন, তাঁদের নিজেদের তালিকার প্রায় কেউই টঙ্গীর ভোটার নন। কাজের জন্য এখানে আসা এই মানুষেরা নিজের এলাকায় ভোটার। এখন সেখানে ফেরার প্রশ্নই আসে না।

মমিনুরের হিসাবে, স্থায়ী বাসিন্দাদের বড় অংশ কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস চলার মতো সংগতি রাখেন। কিন্তু এলাকায় অভিবাসী দিনমজুর বা ছোট ব্যবসায়ীদের সাহায্য না করলে তাঁরা পেটের দায়ে বাইরে বেরোবেন। গ্রামে ফিরতে চেষ্টা করবেন।

ঝরে পড়া শিশুদের জন্য একটি এনজিওর স্কুলে পড়ান রুকসানা খাতুন। তিনি আমাকে ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের গোপালপুরে একটি ঘরে নিয়ে যান। সেখানে স্ত্রী রাজিনা আর তিনটি শিশুসন্তান নিয়ে থাকেন রংপুরের বাবুল। বাবুল নিজের পেট দেখিয়ে বলে চলেন, ‘আমি একটা পাগল মানুষ।’ রোগা একটি কিশোরী মেয়ে আর ছোট একটি ছেলে ছাড়া তাঁদের ঘরের ভেতর আর কোনো সম্পদই দেখলাম না।

আমি একটা পাগল মানুষ––বাবুল
আমি একটা পাগল মানুষ––বাবুল

রাজিনা বলেন, দোকানে দোকানে ভিক্ষা করে খেতেন। এখন বন্ধ। দুদিন না খেয়ে ছিলেন। এক প্রতিবেশী কিছু চাল দিলে আজ ভাত রেঁধে আলু ভাজি করে বাচ্চাদের খেতে দিয়েছেন।

মোসাম্মাত ডলি আক্তার সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের নেত্রী। তিনি বললেন, তাঁর তালিকায় রিকশাচালক, রাজমিস্ত্রি, ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী বা ঝালমুড়ি বিক্রেতা আছেন। ঠিকা গৃহকর্মী আছেন অনেক। গৃহকর্তারা এখন তাঁদের বাসায় ঢুকতে দিচ্ছেন না। অনেককে ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। পরিবারগুলোতে ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেশি।

শিরিনকে এক নারী বলেছেন, হাত ধোয়ার সাবান নেই। তিনি জোগালির কাজ করতেন। আগের দিন সকালে এক প্রতিবেশী এক পোয়া চাল দিলে ভাত রেঁধে খেয়েছেন। এলাকায় নতুন আগতরা দোকান থেকে বাকিতে কেনার সুযোগও পান না।

শিরিন সুলতানা ও রুকসানা খাতুন
শিরিন সুলতানা ও রুকসানা খাতুন

পোশাকশ্রমিকেরা চাকরিজীবী বলে স্বেচ্ছাসেবকেরা তাঁদের তালিকার বাইরে রাখছেন। তাঁরা আজ হোক কাল হোক, বেতন পাবেন। দোকানে বাকিতে খেতে পারবেন।

অথচ আগের দিনই একজন নারী শ্রমিক ডলিকে বলেছেন, তাঁর ধোলাই কারখানায় তিন মাস যাবত বেতন হচ্ছে না। আর শিল্পমালিকদের সিদ্ধান্তের দোষে বন্ধের মধ্যে যে শ্রমিকেরা ফিরেছেন, তাঁরাও এখন ভবিষ্যৎ ভেবে অস্থির।

টঙ্গী বিসিকে বেশির ভাগই রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক আর তার আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের কারখানা। বড় কারখানা যেমন অনেক, তেমনি ঠিকা কাজের ছোট কারখানাও আছে। আছে বদলি বা অস্থায়ী শ্রমিক। তাঁদের অবস্থা বরাবরই নাজুক।

মো. সাদেক আলী ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তিনি আমাকে বললেন, যতটুকু যা সহায়তা আসছে, তাতে ভোটার বা না ভোটার, কারও চাহিদার কণাও মিটবে না। তিনি এলাকার বিত্তশালীদের কাছে আবেদন করছেন।

ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মী সাবিনা ভাবছেন, সবচেয়ে অসহায় মানুষদের ঠিকঠাক তালিকা করা জরুরি। কোনো জায়গায় সাহায্য বিলি করলে মানুষের ভিড়ে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। খাবারটা মানুষকে বাসায় বাসায় পৌঁছে দেওয়া জরুরি।

নয়তো মানুষ ঘরের বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করবেই। করোনা প্রতিরোধ গোল্লায় যাবে। আর মমিনুরের মতে, সরকারকেই পর্যাপ্ত সাহায্য জোগাতে হবে। সেটা বিতরণের কড়া নজরদারি করতে হবে।

মোসাম্মাত ডলি আক্তার
মোসাম্মাত ডলি আক্তার

এই পরামর্শ শুনে আমার মনে হলো, বিবি লায়েক হতে হতে মিয়া না গোরস্থানে চলে যান। সরকার বাহাদুর। তাঁর কাজ তাঁকে আমরা করতে বলবও। কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই বড়সড় কিছু না করেও পাশের মানুষটির যথাসাধ্য দায়িত্ব নিয়ে করোনাযুদ্ধে শামিল হতে পারি।

কেনিয়ার গাছবন্ধু নোবেলবিজয়ী ওয়াঙ্গারি মাথাই একবার একটি গল্প বলেছিলেন। বনে আগুন লেগেছে। বাঘ-সিংহরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। ছোট্ট টুনটুনি কিন্তু ঝরনা থেকে ঠোঁটে একফোঁটা করে পানি এনে আগুনে ঢালছে।

সবাই তাকে বলছে, ফালতু কাজটা থামা। টুনটুনি কিন্তু থামে না। বলে, ‘আমার যতটুকু সামর্থ্য, আমি ততটুকুই করছি!’

কুর্‌রাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা: সাংবাদিক
[email protected]