সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল এখন নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জ

‘হটস্পট’ (অতি ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত নারায়ণগঞ্জ এখন দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ানোর কেন্দ্রে (এপিসেন্টার) পরিণত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েক দিনে অন্তত ছয়টি জেলায় সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন, যাঁরা সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ থেকে গিয়েছেন।

শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন জেলার মানুষের বসবাস। নারায়ণগঞ্জ থেকে সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকাতে গত বুধবার পুরো জেলা লকডাউন (অবরুদ্ধ) করা হয়, কিন্তু সেটা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। লকডাউনের মধ্যেই শত শত মানুষ নারায়ণগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই বিভিন্ন জেলায় করোনায় আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, টাঙ্গাইলে শনাক্ত হওয়া প্রথম ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জের একটি ক্লিনিকে চাকরি করতেন। নরসিংদীতে শনাক্ত দুজন নারায়ণগঞ্জে চাকরি করতেন। গত বুধবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এক ব্যক্তির সংক্রমণ ধরা পড়ে। ওই ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জে একটি ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। অসুস্থ হয়ে ৬ এপ্রিল তিনি সীতাকুণ্ডে চলে যান। এর পরদিন নীলফামারীর সৈয়দপুরে এক ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ে। তিনি নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার একটি রেস্তোরাঁর কর্মী ছিলেন। তিনি ৬ এপ্রিল সৈয়দপুরে গিয়েছিলেন।

গতকাল চাঁদপুরের মতলবে এক যুবকের মধ্যে সংক্রমণ পাওয়া গেছে, যিনি নারায়ণগঞ্জে একটি পোশাক কারখানার কর্মী। ৫ এপ্রিল চাঁদপুরে শ্বশুরবাড়িতে যান। গত বৃহস্পতিবার পটুয়াখালীর দুমকিতে করোনায় আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তিনিও নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তিনি গত রোববার পটুয়াখালীতে যান।

আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনাও বলেছেন, বিভিন্ন জেলায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকে নারায়ণগঞ্জ থেকে গিয়েছেন।

গতকাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলায়। দেশের মোট আক্রান্ত রোগীর ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ এখানকার বাসিন্দা। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১১। ৭ এপ্রিল তা দাঁড়ায় ৩৮ জনে। ৮ এপ্রিল এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৬। ৯ এপ্রিল ছিল ৫৯ জন। সর্বশেষ গতকাল তা গিয়ে ঠেকে ৭৫ জনে।

গতকাল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে মারা যাওয়া ২৭ জনের মধ্যে ৯ জন নারায়ণগঞ্জের। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৩৮ শতাংশ নারায়ণগঞ্জের।

নারায়ণগঞ্জ শহর এলাকা এবং সদর উপজেলায় করোনার প্রকোপ বেশি। শহরের থানা পুকুর পাড়া, নন্দীপাড়া, দেওভোগ আখড়া এবং সদর উপজেলার কাশিপুর আমবাগান ও পূর্বলামাপাড়া; বন্দর উপজেলার রসুলবাগ; রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল, ভুলতা ও নোয়াপাড়া; আড়াইহাজার উপজেলার বিশন্দী ইউনিয়নে আক্রান্ত শনাক্ত আছেন।

দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের ঘোষণা দেয় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। ওই দিন দুই বিদেশফেরতসহ তিনজন শনাক্তের কথা জানানো হয়েছিল। তাঁদের দুজন ছিলেন নারায়ণগঞ্জের। এরপর থেকে সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে, যা এখনো অব্যাহত আছে। গতকাল করোনাভাইরাসের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপনের সময় আইইডিসিআরের পরিচালক বলেছেন, ‘নারায়ণগঞ্জ আমাদের জন্য একটি এপিসেন্টার (সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কেন্দ্র)।’ এর আগে ৭ এপ্রিল এই জেলাকে ‘হটস্পট’ (অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা) ঘোষণা করা হয়েছিল।

অন্য ক্লাস্টারের সঙ্গে তফাত
শুরুতে আইইডিসিআর বাংলাদেশে সংক্রমণের যে পাঁচটি ক্লাস্টার (একটি জায়গায় কম দূরত্বের মধ্যে অনেক রোগী) চিহ্নিত করেছিল, তার একটি নারায়ণগঞ্জ। বাকি চারটি ক্লাস্টারের মধ্যে রাজধানীর বাসাবোতে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ জন, টোলারবাগে ৬ জন, মাদারীপুরে ১১ জন ও গাইবান্ধায় ৫ জন রোগী শনাক্ত হন। আর তখন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে শনা​ক্ত ছিলেন ১১ জন। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাজধানীর টোলারবাগে মোট রোগী ছিলেন (উত্তর টোলারবাগ ও টোলারবাগ মিলিয়ে) ১৪ জন, বাসাবোতে ৯ জন, গাইবান্ধায় ৮ জন ও মাদারীপুরে ১১ জন। অর্থাৎ এই চারটি ক্লাস্টারে নতুন করে সংক্রমণ খুব একটা ছড়ায়নি। এর বিপরীতে নারায়ণগঞ্জ ক্লাস্টারে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে দ্রুতগতিতে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেখানে আক্রান্ত শনাক্ত হন ৫৯ জন। আর গতকাল তা দাঁড়িয়েছে ৭৫ জনে।

লকডাউন ফাঁকি দিয়ে নানা জেলায়
নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে সড়ক ও নৌপথে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। গত বুধবার পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলা লকডাউন করা হয়। কিন্তু এরপরও পণ্যবাহী ট্রাক, ট্রলার, বাস, অ্যাম্বুলেন্স ও মাইক্রোবাসে চড়ে শত শত মানুষ বিভিন্ন জেলায় নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে ফিরে যায়।

গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ থেকে নৌপথে পিরোজপুরের নেছারাবাদে যান ১৮ জন। গ্রামবাসী তাঁদের ঢুকতে বাধা দেয়। পরে পুলিশ তাদের একটি বিদ্যালয়ে কোয়ারেন্টিনে রাখার প্রস্তুতি নিলে গ্রামবাসী হামলা চালায়।

গত বুধবার রাতে দুটি নৌকায় করে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ থেকে গাইবান্ধায় যান ৯২ জন শ্রমিক। খবর পেয়ে স্থানীয় প্রশাসন তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখে।

গত চার–পাঁচ দিনে নারায়ণগঞ্জ থেকে নৌপথে গোপনে কয়েক শ ব্যক্তি চাঁদপুর চলে যায়। তাদের মধ্যে ৫৯৪ জনকে চিহ্নিত করে কো​য়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চাঁদপুর জেলা লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া গত দুই দিনে নারায়ণগঞ্জ থেকে গোপালগঞ্জ, বরিশাল ও মৌলভীবাজারেও অনেকে গেছে বলে জানা গেছে।

লকডাউনের মধ্যে লোকজনের কীভাবে এতগুলো জেলায় ছড়িয়ে পড়ল, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউন নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। যেকোনো মূল্যে লকডাউন শতভাগ নিশ্চিত করা দরকার। এখান থেকে লোকজন বাইরে গেলে সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।

নারায়ণগঞ্জের ভেতরেও বাজার, মহল্লায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন এলাকার কাঁচাবাজার ও পাইকারি বাজারগুলোতে লোকজনের চলাচল দেখা গেছে। তবে সড়কে যানবাহন ও লোকজনের চলাচল কম। গতকাল সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রবেশপথ ও শহরের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারাচৌকি দেখা গেছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউনের আগে ও পরে কিছু লোক ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। এখন আরও কড়াকড়ি করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জ বড় ব্যবসাকেন্দ্র, এখানে জ্বালানি তেলের দুটি ডিপো রয়েছে। এ কারণে লকডাউন শতভাগ কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া পোশাক কারখানার ১০ লাখের বেশি শ্রমিক বাড়ি যেতে পারেননি। তাঁরা নানা অজুহাতে বাইরে বেরিয়ে আসছেন। এ কারণে পাড়া–মহল্লায় পুরোপুরি লকডাউন হচ্ছে না।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক প্রতিনিধিরা)